আগামীকাল
২৪ এপ্রিল ঐতিহাসিক খাপড়া ওয়ার্ড শহীদ দিবস। এ দেশে প্রথম জেলহত্যা সংগঠিত
হয় এই দিনে। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে কমিউনিস্ট
রাজবন্দীদের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের রক্তের
হোলি খেলায় ঝরে যায় ৭টি বিপ্লবী প্রাণ। বন্দী অবস্থায় পুলিশের গুলিতে শহীদ
হন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী সুধীন ধর, বিজন সেন, হানিফ শেখ, সুখেন্দু
ভট্টাচার্য, দেলোয়ার হোসেন, কম্পরাম সিং ও আনোয়ার হোসেন।
পাকিস্তান
প্রতিষ্ঠার পর কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন বাড়তে থাকে।
কমিউনিস্ট বন্দীদের দ্বারা ভরে যায় পূর্ববাংলার কারাগারগুলো। জেলখানায়
রাজবন্দীর মর্যাদা, প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা এবং অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে
জেলের মধ্যেই আন্দোলন শুরু করেন কমিউনিস্ট বন্দীরা। উত্তেজিত ও বেসামাল হয়ে
সরকার কমিউনিস্ট বন্দীদের ওপর দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। প্রতিবাদে
বিভিন্ন জেলে কমিউনিস্ট বন্দীরা অনশন করতে থাকেন।
১৯৫০ সালের এপ্রিল
মাসে রাজশাহী জেলে সাধারণ কয়েদীরা অনশন শুরু করলে কমিউনিস্ট বন্দীরাও যোগ
দেন। ‘ঘানি টানানো হবে না, ভালো খাবার দেওয়া হবে’- এই আশ্বাসের ভিত্তিতে ১৪
এপ্রিল অনশন প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এরপর থেকে কমিউনিস্ট বন্দীদের ওপর
জুলুম বাড়তে থাকে। ২১ এপ্রিল রাজবন্দীদের ধমক দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়, শাস্তি
হিসেবে ১০ জন বন্দীকে কনডেম সেলে (ফাঁসির আসামী যে সেলে রাখা হতো)
স্থানান্তর করা হবে। কমিউনিস্ট কর্মীরা কনডেম সেলে যেতে অস্বীকৃতি জানান।
২৪
এপ্রিল সোমবার আনুমানিক সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে, সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ
সরকারের বিশ্বস্ত তাঁবেদার রাজশাহী জেল সুপারিন্টেনডেন্ট এডওয়ার্ড বিল দলবল
নিয়ে হঠাৎ করেই খাপড়া ওয়ার্ডে ঢুকে পড়েন। এক পর্যায়ে ‘কমিউনিস্টরা
ক্রিমিনাল’ বলে গালি দিতে দিতে বিল ওয়ার্ড থেকে বের হন এবং বের হয়েই দরজা
বন্ধ করার নির্দেশ দেন। বিল বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই পাগলা ঘণ্টা বাজতে
শুরু করে। বিলের নির্দেশে সিপাহীরা বাঁশ দিয়ে জানালার কাঁচ ভেঙে, জানালার
ফাঁকের মধ্যে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে গুলি করতে থাকে। রক্তে ভেসে যায় খাপড়া
ওয়ার্ড। দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে সিপাহী ও কয়েদী পাহারা মেটরা, আহত-নিহত
নির্বিশেষে সবাইকে পেটাতে শুরু করে। এরপর বিলের নেতৃত্বে একদল পুলিশ
ওয়ার্ডে ঢুকে আবার লাঠিপেটা শুরু করে।
রক্তস্নাত খাপড়া ওয়ার্ডে ঘটনাস্থলেই ৫
জন কমরেড শহীদ হন। রাতে আরও দুজন কমরেড মৃত্যুবরণ করেন। তাঁদেরকে হয়তো
বাঁচানো যেত, কিন্তু আহতদের কোনো চিকিৎসাই হয়নি। নিরস্ত্র কমিউনিস্ট
রাজবন্দীদের ওপর ১৮০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল সেদিন। খাপড়া ওয়ার্ডের
জীবিত প্রত্যেক বন্দীই গুলি ও লাঠিচার্জে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন।
খাপড়া
ওয়ার্ডে শহীদ কমিউনিস্ট রাজবন্দীরা হচ্ছেন-১. কমরেড কম্পরাম সিংহ
(কৃষকনেতা, দিনাজপুর), ২. কমরেড সুধীন ধর (রেলশ্রমিক নেতা, রংপুর), ৩.
কমরেড বিজন সেন (শ্রমিকনেতা, রাজশাহী), ৪. কমরেড হানিফ শেখ (শ্রমিকনেতা,
কুষ্টিয়া), ৫. কমরেড সুখেন্দু ভট্টাচার্য (ছাত্রনেতা, ময়মনসিংহ), ৬. কমরেড
দিলওয়ার হোসেন (রেলশ্রমিক নেতা, কুষ্টিয়া)
ও ৭. কমরেড আনোয়ার হোসেন
(ছাত্রনেতা, খুলনা)।
খাপড়া ওয়ার্ডে আহত কমিউনিস্ট রাজবন্দীরা হচ্ছেন
(সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে)-১. কমরেড সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ (কৃষকনেতা,
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার ও পশ্চিমবঙ্গের সাবেক আইনমন্ত্রী) ২. কমরেড
আবদুশ শহীদ (কৃষকনেতা, বরিশাল) ৩. কমরেড আব্দুল হক (যশোর) ৪. কমরেড প্রসাদ
রায় (পাবনা) ৫. কমরেড আমিনুল ইসলাম বাদশা (পাবনা) ৬. কমরেড আশু ভরদ্বাজ
(ফরিদপুর) ৭. কমরেড সত্যেন সরকার (শ্রমিকনেতা, কুষ্টিয়া) ৮. কমরেড
নূরুন্নবী চৌধুরী (রেল শ্রমিকনেতা, খুলনা) ৯. কমরেড প্রিয়ব্রত দাস (সিলেট)
১০. কমরেড অনন্ত দেব (ছাত্রনেতা, সিলেট) ১১. কমরেড গণেন্দ্র নাথ সরকার
(কৃষকনেতা, দিনাজপুর) ১২. কমরেড নাসিরউদ্দিন আহমেদ (ছাত্রনেতা, ঢাকা) ১৩.
কমরেড শচীন্দ্র ভট্টাচার্য (কৃষকনেতা, দিনাজপুর) ১৪. কমরেড সাইমন মণ্ডল
(পশ্চিমবঙ্গ) ১৫. কমরেড কালীপদ সরকার (কৃষকনেতা, দিনাজপুর) ১৬. কমরেড
অনিমেষ ভট্টাচার্য (সিলেট) ১৭. কমরেড বাবর আলী (কৃষকনেতা, সিরাজগঞ্জ) ১৮.
কমরেড গারিসউল্লাহ সরকার (শ্রমিকনেতা, কুষ্টিয়া) ১৯. কমরেড ভূজেন পালিত
(কৃষকনেতা, দিনাজপুর) ২০. কমরেড ফটীক রায় (বগুড়া) ২১. কমরেড সীতাংশু মৈত্র
(রাজশাহী) ২২. কমরেড সদানন্দ ঘোষ দস্তিদার (বরিশাল) ২৩. শহীদ ভোলারাম সিংহ
(রাজশাহী) ২৪. কমরেড সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য (বগুড়া) ২৫. কমরেড লালু পাণ্ডে
(শ্রমিকনেতা, নওগাঁ) ২৬. কমরেড মাধব দত্ত (কৃষকনেতা, জলপাইগুড়ি) ২৭. কমরেড
খবীর শেখ (কৃষকনেতা, দিনাজপুর) ২৮. কমরেড আভরন সিংহ (কৃষকনেতা, ঠাকুরগাঁও)
২৯. কমরেড সুধীর স্যানাল (কুষ্টিয়া) ৩০. কমরেড শ্যামাপদ সেন (সিলেট) ৩১.
কমরেড হীরেন সেন (সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতা, যশোর) ৩২. কমরেড পরিতোষ
দাশগুপ্ত (খুলনা)।
খাপড়া ওয়ার্ড শহীদ দিবসে সিপিবির আহ্বান
বাংলাদেশের
কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সভাপতি কমরেড মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ
সম্পাদক কমরেড রুহিন হোসেন প্রিন্স এক বিবৃতিতে খাপড়া ওয়ার্ডের শহীদদের
প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
বিবৃতিতে সিপিবির নেতৃবৃন্দ বলেছেন,
খাপড়া ওয়ার্ডের লড়াই আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী আন্দোলনের
ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ পর্ব। খাপড়া ওয়ার্ডের লড়াই আজও
আমাদের উজ্জীবিত করে, পথ দেখায়। শুধু ইতিহাসকে জানার জন্যই নয়, ভবিষ্যতের
দিশা পাবার জন্যও খাপড়া ওয়ার্ডের লড়াইকে অনুধাবন করা জরুরি।
বিবৃতিতে খাপড়া
ওয়ার্ডের গৌরবোজ্জ্বল কাহিনী ও শিক্ষা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং
সবখানে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
খাপড়া ওয়ার্ড শহীদ দিবসে সিপিবির কর্মসূচি
খাপড়া
ওয়ার্ড শহীদ দিবসে আগামীকাল ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি
(সিপিবি)’র একটি প্রতিনিধি দল রাজশাহী জেলের অভ্যন্তরে খাপড়া ওয়ার্ড শহীদ
স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি
(সিপিবি)’র উদ্যোগে আগামীকাল ২৪ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার, বিকেল ৫টায়
মুক্তিভবনের মৈত্রী মিলনায়তনে (২, কমরেড মণি সিংহ সড়ক, পুরানা পল্টন, ঢাকা)
এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।