ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বানে নারী গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত
Posted: 27 নভেম্বর, 2020
‘সারাদেশে অব্যাহত ধর্ষণ, নারী-শিশু নিপীড়ন ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোরদার করুন’- এই আহ্বানে আজ ২৭ নভেম্বর ২০২০ শুক্রবার বিকাল ৩টায় ঢাকার শাহবাগস্থ জাতীয় জাদুঘরের সামনে নারী গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
কর্মসূচির শুরুতে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী ও চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এরপর শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত এক বর্ণাঢ্য মিছিল শাহবাগ থেকে শুরু হয়ে কাঁটাবন মোড়, বাটা মোড় হয়ে শাহবাগে এসে শেষ হয়। মিছিল শেষে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সিপিবি নারী সেলের আহ্বায়ক লক্ষ্মী চক্রবর্তী এবং সমাবেশ পরিচালনা করেন সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শম্পা বসু। সমাবেশে বক্তব্য প্রদান করেন শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর সভাপতি বহ্নিশিখা জামালী, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত, নারী সংহতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তাসলিমা আখতার এবং বিপ্লবী নারী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক আমেনা আক্তার। সমাবেশ থেকে আগামী মাসব্যাপী সারাদেশের জেলায় জেলায় নারী সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
সভাপতির বক্তব্যে লক্ষ্মী চক্রবর্তী বলেন, সারাদেশে ধর্ষণ, নারী-শিশু নির্যাতন এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানাসহ দেশের কোন একটি জায়গা নেই যেখানে নারীরা নির্যাতনের শিকার হন না। একের পর এক ধর্ষণ-নিপীড়ন ঘটে চলেছে আর একটি ঘটনা বর্বরতায়, বিভৎসতায় আগেরটিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। এসব ধর্ষণ, নারী নিপীড়নের ভয়াবহতা আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হানাদারবাহিনী দ্বারা সংঘটিত নারী নির্যাতনকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। আর অন্যদিকে দেশে চলছে বিচারহীনতার প্রবণতা। নারী-শিশু ধর্ষণ-নির্যাতনের ১০০টি মামলার ৯৭টির-ই কোন বিচার হয় না। কেবল মাত্র ৩টি মামলার বিচার হয়। ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে ও অর্থের দাপটে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। তার ফলে ধর্ষকেরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক লুটপাটের দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি এবং গণতন্ত্রহীনতাই বিচারহীনতার জন্ম দিয়েছে।
বক্তাগণ বলেন, কোন মানুষ ধর্ষক হয়ে জন্মগ্রহণ করে না; সমাজের নানা অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণবিধির মধ্যেই সে ধর্ষক হয়ে ওঠে। ধর্ষণের অন্যতম কারণ সমাজে নারী-পুরুষের অধিকারের সীমাহীন অসমতা, সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা না দেওয়া, অধস্তন হিসেবে দেখা, বলপ্রয়োগের অপরাজনীতি, বিচারহীনতা, মৌলবাদ, প্রতিক্রিয়াশীল কূপমণ্ডুক দৃষ্টিভঙ্গী, নারীকে ভোগ্য পণ্য হিসেবে উপস্থাপন, মাদক, পর্নোগ্রাফি সর্বপরি ভোগবাদী পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
সমাবেশে বক্তাগণ ধর্ষণ, নারী-শিশু নিপীড়ন ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে গণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সকল গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন বিবেকবান মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। সমাবেশে নিম্নলিখিত দাবি উপস্থাপন করা হয় এবং এ দাবিতে মাসব্যাপী জেলায় জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ এর কর্মসূচি সফল করার ঘোষণা দেয়া হয়-
দাবিসমূহ:
১। সারাদেশে অব্যাহতভাবে ধর্ষণ, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার সাথে যুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২। পাহাড়-সমতলে আদিবাসী নারীদের ওপর সামরিক-বেসামরিক সকল প্রকার যৌন ও সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে।
৩। হাইকোর্টের নির্দেশানুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি, বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতন বিরোধী সেল কার্যকর করতে হবে।
৪। সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করতে হবে। বাংলাদেশকে সিডো সনদের ২ এবং ১৬-১ (গ) ধারা স্বাক্ষর করে সিডো সনদের পূর্ণ অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল আইন ও প্রথা বিলোপ করতে হবে।
৫। ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন-১৮৭২-১৫৫(৪) ধারাকে বিলোপ করতে হবে এবং মামলার ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে।
৬। অপরাধ বিজ্ঞান ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। ট্রাইবুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে অনিষ্পন্ন সকল মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন করতে হবে।
৭। তদন্তকালীন সময়ে ভিকটিমকে মানসিক নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ভিকটিমের আইনগত ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৮। ধর্মীয়সহ সকল ধরনের সভা-সমাবেশে নারী বিদ্বেষী সংবিধান বিরোধী বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা বন্ধ করতে হবে। পর্নোগ্রাফি নিয়োন্ত্রণে বিটিসিএল এর কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক চর্চায় সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।
৯। সারাদেশে মাদক বন্ধে সরকারিভাবে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
১০। পাঠ্যপুস্তকে বিদ্যমান নারীর প্রতি অবমাননা ও বৈষম্যমূলক যে কোন প্রবন্ধ, নিবন্ধ, পরিচ্ছদ, ছবি, নির্দেশনা ও শব্দ চয়ন পরিহার করতে হবে।
১১। গ্রামীণ সালিশের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।