ভিডিওবার্তায় সিপিবির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
‘নিজের ভোট নিজে পাহারা’ দিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে সরকারের নীল নকশা বানচাল করুন
Posted: 27 ডিসেম্বর, 2018
গত ২৬ ডিসেম্বর রাত ৮টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, ‘২০১৪ সালের মতো এবারও খালি মাঠে গোল দেয়ার সুযোগ করে নিতে না পারায় আওয়ামী লীগ সরকার এবার সন্ত্রাস, হামলা, হুমকি, গায়ের জোর, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক শক্তি সবকিছুকে ব্যবহার করে ‘ভোটের আগেই জয়লাভ করার’ আয়োজন করেছে।’
ভিডিওবার্তায় কমরেড সেলিম ‘নিজের ভোট নিজে পাহারা’ দিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে সরকারের নীল নকশা বানচাল করার আহ্বান জানান।
ভিডিওবার্তায় দেওয়া কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সম্পূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরা হলো :
“আগামী ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
সরকারের ১০ বছরের দুঃশাসনের ফলে সে আজ জনসমর্থন হারিয়েছে। কিন্তু আরো এক দফা ক্ষমতায় থাকার জন্য সে মরিয়া। ২০১৪ সালের মতো এবারও খালি মাঠে গোল দেয়ার সুযোগ করে নিতে না পারায় সে এবার সন্ত্রাস, হামলা, হুমকি, গায়ের জোর, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক শক্তি সবকিছুকে ব্যবহার করে ‘ভোটের আগেই জয়লাভ করার’ আয়োজন করেছে। এ কাজে সে সফল হলে আগামী পার্লামেন্ট হয়ে উঠবে ‘ভূয়া প্রতিনিধিদের’ পার্লামেন্ট। ফলে গণতন্ত্র আরো বিপন্ন হবে এবং দেশে স্বৈরতান্ত্রিক-এনায়কত্ববাদী-ফ্যাসিবাদী বিপদ বাড়বে। এটি হতে দেয়া যায় না। কেবল জনগণের শক্তিই সরকারের এই ‘খেলা’ বন্ধ করতে পারে। ‘নিজের ভোট নিজে পাহারা’ দিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে সরকারের এই নীল নকশা বানচাল করা সম্ভব হবে। আমি দেশবাসীকে আহবান জানাচ্ছি-ভোটাধিকার রক্ষায় সমবেতভাবে ও সাহসের সাথে এগিয়ে আসুন। সকাল সকাল ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নিজ নিজ ভোটাধিকার প্রয়োগ করুন।
দেশ আজ লুটপাটতন্ত্র, গণতন্ত্রহীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদের কবলে। কিন্তু এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। দেশ পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে। ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না’-এই নীতির ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা-এই চার নীতির আলোকে দেশ চলবে, এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদদের ও আপামর জনগণের স্বপ্ন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত জনগণ যে ধরনের বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিল, তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। সেই স্বপ্নই হলো আমাদের ‘ভিশন-মুক্তিযুদ্ধ ৭১’। বর্তমান সময়ের সুনির্দিষ্ট বাস্তবতায় এই ‘ভিশন-মুক্তিযুদ্ধ ৭১’ নবায়নের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়াই আজ জাতির সামনে মৌলিক কর্তব্য।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাদের অক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। এমনকি, এই দুটি দল ও তাদেরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দ্বি-দলীয় রাজনৈতিক কাঠামো দেশে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক স্বপ্নতো দূরের কথা, বুর্জোয়া ধারার গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বরং যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা ক্রমান্বয়ে আরও কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে। বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের ধারার বিপরীতে দেশে লুটপাটতন্ত্রের ধারা শক্তিশালী করেছে।
বাংলাদেশ এখন দুই ভাগে বিভক্ত। আমাদের দেশের সম্পদ সৃষ্টি করেন প্রধানত মেহনতি কৃষক, গার্মেন্টস শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষ ও বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রেমিটেন্স পাঠানো প্রবাসীসহ সাধারণ মানুষরা। অথচ এই ‘নিরানব্বই ভাগ’ মানুষের সৃষ্ট সম্পদ থেকে তাঁদেরকেই বঞ্চিত করছে ‘এক ভাগ’ লুটোরা। ‘এক ভাগ’ লুটপাটকারী গোষ্ঠীর সঙ্গে ‘নিরানব্বই ভাগ’ জনগণের স্বার্থের দ্ব›দ্বই এখন সমাজে প্রধান দ্ব›দ্ব। এই দুটি রাজনৈতিক দল একে অপরের বিকল্প নয়-তারা আসলে একই পক্ষের, তথা সমাজের ‘এক ভাগ’ লুটেরা শোষকদের পক্ষের, দুটি প্রধান বিবাদমান গোষ্ঠী। এমতাবস্থায়, ‘এক ভাগ’ মানুষের পকেট ভরার তথাকথিত উন্নয়নের মডেল পরিত্যাগ করে, ‘নিরানব্বই ভাগ’ মানুষের অংশগ্রহণে এবং তাঁদের স্বার্থে 'সমাজতন্ত্র অভিমুখীন' উন্নয়ন ধারার ‘বিকল্প পথ’ অনুসরণ করা আজ অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে উঠেছে।
জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে বিদ্যমান ‘ব্যবস্থা বদল’ করা এবং দ্বি-দলীয় রাজনীতির বৃত্ত ছিন্ন করে বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি-সমাবেশ গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এই ‘পরিবর্তন’ আজ শুধু অপরিহার্যই নয়, ‘পরিবর্তন’ আজ সম্ভবও বটে। গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান, সাম্প্রতিক কিশোর বিদ্রোহ, কোটা সংস্কার আন্দোলন ইত্যাদির ভেতর দিয়ে তার প্রামাণ্য নিদর্শন পাওয়া গেছে। সেই নতুনের কেতন, তারুণ্যের প্রাণতরঙ্গকে ধারণ করে কমিউনিস্ট পার্টি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
কোন পথে ও কোন ব্যবস্থায় সিপিবি দেশ পরিচালনা করবে সে সম্পর্কে সিপিবির প্রস্তাবগুলো ৩০টি অনুচ্ছেদ ও ২০১টি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের সুপারিশ সম্বলিত নির্বাচনী ইশতেহারে আমরা ঘোষণা করেছি।
আমরা দেশকে উন্নয়নের সঠিক ধারায় এগিয়ে নেব। উন্নয়নের হার ও গতি বৃদ্ধি করব। গণতন্ত্রকে নিরঙ্কুশ করে জনগণের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়ন সাধন করবো। সেই উন্নয়নে লুটপাটের কোনো সুযোগ থাকবে না। এবং উন্নয়নের ফসল সমতার ভিত্তিতে সমস্ত জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এবং সমবায়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক তৎপরতা বিপুলভাবে বাড়ানো হবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে একদিকে সম্পদ বৃদ্ধি এবং অপরদিকে জনগণের প্রকৃত আয় বাড়ানো হবে। গ্রাম অভিমুখীন এবং দরিদ্র অভিমুখীন কর্মকৌশল গ্রহণ করা হবে। বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
একি সাথে, জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র ও প্রশাসনের গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ সাধন করা হবে। মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা হবে। বাক্-ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা হবে। ৭২-এর সংবিধানের মূল ভিত্তি অবিকৃতভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ও বহুমুখী অভিযান চালানো হবে। সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা চালুসহ নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করা হবে।
ঘুষ-দুর্নীতি, লুটপাট, মাদক, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মাস্তানি ইত্যাদির বিরুদ্ধে কঠোর ও সর্বাত্মক অভিযান সফল করা হবে। গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ব্যাংক লুট, বিদেশে অর্থ পাচারসহ অপরাধসমূহ কঠোরভাবে দমন করা হবে।
সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে জাতীয় মর্যাদাকে নিষ্কলুষ ও সমুন্নত রাখা হবে।
জনজীবনের সংকট নিরসনে জরুরি উদ্যোগ নেয়া হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেশনিং ব্যবস্থা চালু ও গণবণ্টন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। নৌ ও রেল যোগাযোগসহ গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি করা হবে।
নারী সমাজ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশ, জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এক কথায় সিপিবির ইশতেহারে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশ পরিচালনার বিকল্প নীতি উত্থাপন করা হয়েছে। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশিত পথ।
জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই বিকল্প রাজনৈতিক কর্মসূচি ও প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করতে সিপিবি বদ্ধপরিকর।
সিপিবির আহ্বান-সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘কাস্তে’ মার্কায় সিপিবির মনোনীত প্রার্থীদেরকে এবং ‘মই’ ও ‘কোদাল’ মার্কায় বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্য প্রার্থীদের ভোট দিয়ে বিজয়ী করুন।”
ভিডিওবার্তার লিংকঃ
https://www.facebook.com/www.cpbbd.org/videos/2176261405956652/