সিপিবির প্রাথমিক বাজেট-প্রতিক্রিয়া
চটকদার কিন্তু গণ-প্রতারণামূলক এ বাজেট গ্রহণযোগ্য নয়
Posted: 07 জুন, 2018
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড মো. শাহ আলম আজ জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বাজেট প্রস্তাবকে একটি চটকদার কিন্তু গণপ্রতারণামূলক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলেছেন যে এই বাজেট ১% লুটেরা ধনীকদের আরো ধনী করবে এবং ৯৯% গরিব-মধ্যবিত্তকে আপেক্ষিকভাবে আরো দরিদ্র ও আর্থিকভাবে অসহায় করে তুলবে। বাজেটকে তারা সাম্রাজ্যবাদ ও লুটেরা ধনিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষার গণবিরোধী দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখান করেছেন।
বাজেট সম্পর্কে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সিপিবি নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাজেট প্রস্তাবের ভিত্তি হলো পুঁজিবাদের নয়া উদারবাদী প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন। এই বাজেটে সমাজতন্ত্রসহ রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির কোনো প্রতিফলন নেই। শুধু তাই নয়, এই বাজেট মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী আদর্শে প্রণীত হয়েছে। প্রস্তাবিত রাজস্ব আয়ে পরোক্ষ কর প্রত্যক্ষ করের দ্বিগুণ নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢালাও ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ পরোক্ষ কর থেকে এই বর্ধিত রাজস্ব আদায়ের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা সকল পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে মূল্যস্ফীতির হারকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাবে। আর এই দুঃসহ ভারের সবটাই বহন করতে হবে গরিব-মধ্যবিত্তসহ সাধারণ নাগরিকদেরকে। অথচ বিত্তবানদের উপর ধার্য্য প্রত্যক্ষ কর একই পর্যায়ে রাখা হয়েছে, কর্পোরেট কর কমানো হয়েছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর রেয়াত অব্যাহত রাখা হয়েছে, অপ্রদর্শিত কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছেÑইত্যাদি। এই বাজেটে এভাবে গরিব জনগণের সম্পদ মুষ্ঠিমেয় লুটেরা ধনিকের হাতে প্রবাহিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাজেটে কথার ফুলঝুরি ও মিথ্যা আশ্বাসে ভরা লোক দেখানো মনোতুষ্টির নিস্ফল প্রয়াস চালানো হলেও, এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে বাজেটের আসল লক্ষ্য হলো জনগণের ট্যাক্সের টাকায় দেশি-বিদেশি লুটপাটকারীদের পকেট ভারী করা।
এবারের বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ স্মরণকালে সর্বোচ্চ। ঘাটতির পরিমাণ ১ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। এই বিপুল পরিমাণ বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য ভবিষ্যত প্রজন্মের কাঁধে বিশাল ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে বাজেটের পরিমাণকে ৪ লক্ষ ৬৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এই অর্থের বেশিরভাগ খরচ হবে পূর্বেকার ঋণ পরিশোধ, শ্বেতহস্তির মতো বিশাল সিভিল-মিলিটারি প্রশাসনের রক্ষণাবেক্ষণ, বিলাস দ্রব্য আমদানি, অপচয়, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন প্রকারের সিস্টেম লস, কর-রেয়াতের নামে ধনিক শ্রেণিকে বিশাল ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি কাজে। এসবই হলো লুটেরা ধনিক শ্রেণির স্বার্থে গৃহীত পদক্ষেপ। এর বাইরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ এবারও অব্যাহত রাখার মাধ্যমে অর্থনীতিতে লুটপাটের ধারা আরো জোরদার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ধনীকে আরো ধনী এবং গরিবকে আরো গরিব করা, ধন-বৈষম্য ও শ্রেণি-বৈষম্য বৃদ্ধি করা, সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য বৃদ্ধি করা ইত্যাদি হবে এই বাজেটের ফলাফল। এই বাজেট জাতির অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিম-লে নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা ও নাজুকতা বাড়িয়ে তুলবে।
এসব মৌলিক নেতিবাচক চরিত্রকে আড়াল করার জন্য বাজেটে কিছু চটকদার ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাবও করা হয়েছে। কয়েকটি মেগা প্রজেক্টের জন্য বড় আকারের পৃথক থোক বরাদ্দ রাখা হলেও, স্থানীয় সরকারের জন্য বাজেটের কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ ‘থোক বরাদ্দ’ রাখা হয়নি। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ পর্যাপ্ত পরিমানে বৃদ্ধির দাবি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং উল্টো কোনো কোনো ক্ষেত্রে আনুপাতিক বরাদ্দ কমানো হয়েছে। সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য কিছু প্রতীকী পদক্ষেপের ছিটেফোঁটা যুক্ত করা হয়েছে। বাজেট ও সম্পূরক বাজেটের মধ্যে বিপুল পার্থক্য একথাই প্রতিষ্ঠা করেছে যে বাজেট প্রস্তাব নিছক একটি কথার কথা মাত্র। বাজেটকে অনির্ভরযোগ্য ও অবাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাবে পরিণত করা হয়েছে। বাজেটের তথ্য-ভিত্তির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। তাই, প্রস্তাবিত জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে সরকারের আন্তরিকতা ও সেসব বাস্তবায়নে তার সক্ষমতা-যোগ্যতাও মানুষের মনে প্রশ্নবিদ্ধ।
বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ উত্থাপিত বাজেট প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় সমাজতন্ত্র, দরিদ্র জনগণের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা, প্রগতি ও আত্মনির্ভরশীলতার ধারায় প্রগতিশীল বাজেট প্রণয়নের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান।