অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষে সিপিবি’র আন্তর্জাতিক সেমিনারে বক্তারা সমাজতন্ত্রের লাল পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে হবে

Posted: 10 নভেম্বর, 2017

অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শতবর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র উদ্যোগে আজ ১০ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, বিকেল ৩টায়, ঢাকার তোপখানা রোডের বিএমএ মিলনায়তনে ‘সমকালীন পুঁজিবাদ ও অক্টোবর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ, দেশের শীর্ষ বামপন্থি রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম-এর সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কমরেড হায়দার আকবর খান রনো। সেমিনারে বক্তব্য রাখেন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি-মার্কসবাদী (সিপিআইএম)’র পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড বৃন্দা কারাত, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রবোধ পাণ্ডা, নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল)’র কেন্দ্রীয় নেতা কমরেড বিজয় বাহাদুর কুনাড়, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা কমরেড মনজুরুল আহসান খান, ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ’র সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক কমরেড সাইফুল হক। সেমিনার পরিচালনা করেন সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড হাসান তারিক চৌধুরী। সেমিনারে কমরেড বৃন্দা কারাত বলেন, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গভেদে, জাত-পাতের নামে যে বৈষম্য সমাজে চলছে তার পরিচালক নয়া-উদারনীতিবাদ। পৃথিবীতে বৈষম্য এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, ৩.৮ বিলিয়ন মানুষের সম্পদের সমান মাত্র আটজন ব্যক্তির সম্পদ। যেখানে মানব সমাজে উৎপাদন ব্যবস্থার এতো উন্নতি হয়েছে সেখানে খাদ্যের অভাবে মানুষ মারা যাবে এটা বরদাশত করা যায় না। রুশ বিপ্লব দেখিয়েছিলো মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ বৈষম্য মিটিয়ে দেয়া সম্ভব। আজকের দুনিয়ায় একারনেই রুশ বিপ্লব প্রাসঙ্গিক। তিনি আরো বলেন, ভারতের বহুত্ববাদী সমাজে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী শক্তির যে উত্থান ঘটছে তার দ্বারা গোটা উপমহাদেশ আক্রান্ত হবে। শ্রমিক শ্রেণিকে অক্টোবর বিপ্লবের শিক্ষায় দীক্ষিত করে তার নেতৃত্বে এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কমরেড প্রবোধ পান্ডা তাঁর বক্তব্যে বলেন, লগ্নিপুঁজির বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম এই সংগ্রাম সারা দুনিয়ার মেহনতি মানুষকে আজ এক করেছে। অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষে পৃথিবীর সর্বত্র সমাজতন্ত্রীদের লাল পতাকার মিছিল প্রমাণ করেছে এই যুগ সমাজতন্ত্রের যুগ। পুঁজিবাদের পতন শুধু অনিবার্যই নয়, অপরিহার্য বটে। তিনি সারা দুনিয়ার মার্কসবাদীদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সংহতি জোরদার করার আহ্বান জানান। সভাপতির বক্তব্যে কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, চলমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে সংশোধনের কোন সুযোগ নেই। মানুষের ওপর শোষণ ও নির্যাতন বন্ধে তাই সমাজতন্ত্রই ভরসা। এজন্য লাল পতাকাকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। তিনি বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্বের অবসান ঘটেছিল। শুধু অর্থনৈতিক শোষণ নয়, অন্যান্য ধরনের সামাজিক শোষণেরও অবসান ঘটেছিল। এই সব দৃষ্টান্ত পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্থ দেশসমূহেও প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনাকে নতুন ও উন্নত স্তরে উন্নীত করতে সাহায্য করেছিল। তিনি আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি সমাজতন্ত্র। যারা সমাজতন্ত্রকে অস্বীকার করে তারা কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়তে হলে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামের পতাকাতলে আমাদের একত্রিত হতে হবে। অন্যান্য বক্তারা বলেন, সর্বহারা শ্রেণি মাত্র একটি দেশে, রাশিয়াতে বিজয় অর্জন করেছিল, অথচ তার প্রভাব পড়েছিল সারা বিশ্বে। এই বিপ্লব অন্যান্য দেশের শ্রমিক, কৃষক ও শোষিত শ্রেণিকে মুক্তি-সংগ্রামের জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র পৃথিবীর বহু বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক, শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদকে আকৃষ্ট করেছিল। অক্টোবর বিপ্লবের জন্যই উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশ দেশগুলো জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য লাভ করছিল; গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকের মধ্যেই সারা পৃথিবী থেকে পুরনো উপনিবেশবাদ পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল, এর পথ ধরে পরাধীন জাতিগুলো ত্রুত স্বাধীনতাও অর্জন করেছিল। বক্তারা বলেন, অক্টোবর বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন সারা দুনিয়ার মানুষের চিন্তা-চেতনাকেও প্রগতির অভিমুখে প্রভাবিত করেছিল। শক্তিশালী নারী-মুক্তি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। গড়ে উঠেছিল বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ও জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন। পুঁজিবাদ এখন দেশে দেশে নিত্য নতুন ফ্রন্ট খুলে যুদ্ধের ষড়যন্ত্র করছে বলেও অভিযোগ করেন সেমিনারের আলোচকরা। বাড়ছে শোষণ, কমছে মৌলিক মানবাধিকার, বেঁচে থাকার সুযোগ। এ ধরণের অসহিষ্ণু পরিস্থিতিতেও পথ দেখাতে পারে একমাত্র অক্টোবর বিপ্লব; বক্তারা অক্টোবর বিপ্লবের পথ ধরে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম জোরদার করার আহ্বান জানান।