সরকারের প্রতি হাওর কনভেনশনের আহ্বান
হাওরের সকল জনমহালের ইজারা বাতিল করে
জনসাধারণের মাছ ধরার জন্য উন্মুক্ত করে দিন
Posted: 20 মে, 2017
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ আহুত আজকের ‘হাওর কনভেনশন’ এ সরকারের কাছে উপরোক্ত আহ্বান জানানো হয়। মণি সিংহ-ফরহাদ ট্রাষ্টের শহীদ তাজুল মিলনায়তনে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এ কনভেনশনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি)’র সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ’র সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, লেখক-সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকী, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার, প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক, কৃষি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন, বাপা সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিন, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জাব্বার, হাওর আন্দোলনের নেতা এডভোকেট হাসনাত কাইয়ূম, বিশিষ্টসঙ্গীত শিল্পী কফিল আহমদ, হাওর গবেষক হালিমদাদ খান, পরিবেশবিদ পাভেল পার্থ। হাওরবাসীদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সুনামগঞ্জের চিত্তরঞ্জন তালুকদার, মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান, ধনঞ্জয় পাল, আব্দুল বারেক, নেত্রকোনার গোলাম রাব্বানী, হাবিবুর রহমান, এমদাদুল হক শাহ রেন্টু, মৌলভীবাজারের জহর লাল দত্ত, কিশোরগঞ্জের লুৎফর রহমান, মোস্তফা জালাল মর্তুজ, হবিগঞ্জের পিযুষ চক্রবর্তী, এ আর সি কাউসার, কিশোরগঞ্জের এনামুল হক ইদ্রিস, নুরুল হক ভূইয়া। কনভেনশনে লিখিত বক্তব্য উত্থাপন করেন সিপিবি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষক নেতা কমরেড সাজ্জাদ জহির চন্দন। কনভেনশন পরিচালনা করেন বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড বজলুর রশিদ ফিরোজ।
সভাপতির বক্তব্যে কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, এ বছরে হাওরে মহা বিপর্যয় নেমে এসেছে। প্রায় ৯০ শতাংশ বোরো ধান নষ্ট হয়েছে। মাছ, হাঁসসহ জলজ প্রাণী মরেছে। ধান কাটতে না পারায় পশু খাদ্যের সংকট তীব্র হয়েছে। আগামী বোরো মৌসুমের আগে ধান আসবে না কৃষকের ঘরে ফলে খাবারের সংস্থান করা, ঋণ পরিশোধ করা, গরু-মহিষ-ছাগল, হাঁস-মুরগী বাঁচানো কৃষকের কাছে এক ভয়াবহ বিপদ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। এর জন্য দায়ী যেমন অকাল অতি বর্ষণ তেমনি দায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড, পিআইসি কর্মকর্তাদের গাফিলতি এবং ঠিকাদারদের দুর্নীতি। ফেব্রুয়ারি মাসে বাঁধ মেরামত করার কথা থাকলেও মার্চ মাসে মেরামতের কাজ শুরু করেনি ঠিকাদাররা। ফলে আগাম বন্যায় ডুবে গেছে হাওরের ৯ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান, সর্বশান্ত হয়েছে ২৫ লক্ষ কৃষক পরিবার। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ব্যাংক, এনজিও ঋণ মওকুফ এবং আগামী বছর বিনা সুদে কৃষি ঋণ দেয়ার দাবি জানান। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের স্বার্থে হাওরে এ বছরের জলমহালের ইজারা বাতিল করে ভাসান পানিতে জনসাধারণের মাছ শিকারের অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানান। তিনি আরো বলেন, ইজারাদারদের দিয়ে বাঁধ মেরামত না করে স্থানীয় জনগণকে অনুপ্রাণিত করে ‘জন ব্রিগেড’ গঠন করে বাঁধ মেরামত করলে এ ধরণের গাফিলতি ও দুর্নীতি থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র মুক্তি পাবে এবং জনগণের চাহিদা ও সময়মত তা নির্মিত হবে।
বাসদ সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান দিনব্যাপী আলোচনার সার সংক্ষেপ করতে গিয়ে বলেন, আগাম অতিবৃষ্টি আর মনুষ্যসৃষ্ট মহা বিপর্যয়ে হাওর অঞ্চলে ১১ হাজার কোটি টাকার ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। দুই হাজার মেট্রিক টন মাছ নষ্ট হয়েছে। অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছে হাওরবাসী। তিনি বলেন, হাওর অঞ্চলের নদী ও খালগুলোর তলদেশ পলিতে ভরাট হয়ে গেছে। নদী খননের ঘোষণা ও বরাদ্দ থাকলেও যথাযথভাবে তা করা হচ্ছে না। দুর্নীতিবাজ আমলা ও সরকার দলীয় পরিচয়ে কাজ পাওয়া ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে দাবী জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, হাওরে প্রধান গুরুত্ব পাওয়া উচিত ছিল মৎস্য ও জলজ প্রাণী। সে গুরুত্ব দেয়া হযনি। ফলে হাওর উন্নয়ন নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিতে সংকট রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং টিকে থাকার জন্য অবদান রেখেছে এবং রাখছে যে কৃষকরা, তারা আজ অবহেলিত। তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে রাষ্ট্রের দ্বারাই। রাষ্ট্র এখন জনগণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেছে। ফলে জনগণের কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করা। তিনি বলেন, আমলা ও ঠিকাদারদের চক্রের কারণে হাওরবাসী আজকে এই মহাবিপদে পতিত হয়েছে। ফলে এদের উচ্ছেদ ছাড়া হাওরবাসীর মুক্তি নেই। তিনি আরো বলেন, এ কনভেনশনে যে দাবিগুলো উত্থাপিত হয়েছে সেগুলো নিয়ে আন্দোলন করতে হবে এবং তা আদায়ও করতে হবে। কিন্তু মূল আন্দোলন হচ্ছে এ রাষ্ট্র পরিবর্তন করা এবং সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ৩০ কেজি চাল, নগদ ৫০০ টাকা দিয়ে পাঁচ সদস্যের একটি পরিবার এক মাসের ভরপোষণ কোনোভাবে হতে পারে না। হাওরে ২৫ লক্ষ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকার ৩ লক্ষ পরিবারকে সহযোগিতা দিচ্ছে, বাকীদের কী হবে? যারা পাচ্ছে- তাদের দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে দেওয়া হচ্ছে। ফলে অনেক প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত বিশেষ করে নারী প্রধান পরিবারগুলো সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি পরিবার প্রতি বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে এবং সুবিধাভোগী পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সরকারের কাছে দাবি জানান। তিনি বলেন, ত্রাণের জন্য একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আসার যে নিয়ম তা পরিবর্তন করে ক্ষতিগ্রস্তদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। তিনি ত্রাণ কাজে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা গ্রহণের যে দাবি উত্থাপন করা হয়েছে তার বিরোধিতা করে বলেন সেনাবাহিনী নয় বরঞ্চ স্থানীয় নারী-পুরুষের সমবায়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর মাধ্যমে ত্রাণ কাজ পরিচালনা করতে হবে। এতে পরস্পর মনিটরিংয়ের কারণে ত্রাণ কাজে দূর্নীতি হ্রাস পাবে।
লেখক-সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, হাওর অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করার দাবির প্রেক্ষিতে ত্রাণ সচিব যে উপহাস করেছেন তা দিয়েই জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ বোঝা যায়। তিনি প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
সিপিবি-বাসদ উত্থাপিত ধারণাপত্রে হাওর সমস্যাকে দৃষ্টিভঙ্গি ও মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যা আখ্যায়িত করে চলমান বিপর্যয় থেকে হাওরবাসীকে রক্ষা ও হাওর সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য ১৬ দফা দাবিনামা উত্থাপন করা হয়, যা কনভেনশনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
কনভেনশন থেকে ঘোষিত কর্মসূচী ঃ
৮ জুন : হাওর উপজেলাসমূহে ১৬ দফা দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ।
১০ জুন : কিশোরগঞ্জ শহরে হাওর সম্মেলন।
১৬ দফা দাবিসমুহ:
১. আগাম ঢল, অতিবৃষ্টি কবলিত হাওর অঞ্চলকে “দূর্গত এলাকা” ঘোষণা ও হাওর সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।
২. দূর্গত এলাকায় হাওরের সকল জলমহালের ইজারা বাতিল করে জনসাধারণের মাছ ধরার জন্য উন্মুক্ত রাখার ঘোষণা।
৩. সারা বছর দুর্গত হাওরবাসীর সকলের জন্য রিলিফ ও রেশনের মাধ্যমে পর্যাপ্ত চাল, ডাল, তেল, লবণসহ ৮টি নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া।
৪. সবজি বীজ সরবরাহ, হাঁস-মুগরী গরু-ছাগলের ভ্যাকসিন প্রদান, উচু অঞ্চলে রবি চাষে উদ্বুদ্ধ করা এবং এজন্য প্রণোদনা দেওয়া।
৫. ত্রাণ বিতরণে ঘুষ, লুটপাট-দুর্নীতি-দলীয়করণ বন্ধ, ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিতরণ ও ত্রাণ সাহায্যে পরিমাণ বৃদ্ধি।
৬. পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছের পোনা সরবরাহ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ঠিক রেখে মাছের অভয়ারণ্য তৈরি করা। গবাদিপশুর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ।
৭. দুর্গত এলাকার চাষীদের জন্য সুদসহ সকল প্রকার কৃষি ঋণ, এনজিও ঋণ, মহাজনী ঋণ মওকুফ করে আগামী ফসলের জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ কৃষি উপকরণ ও নতুন করে সুদমুক্ত কৃষিঋণ প্রদান এবং শস্য বীমা চালু।
৮. চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ।
৯. পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঠিকাদার, পিআইসি ও সরকারি দলের দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিসহ দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা।
১০. পরিকল্পিতভাবে হাওর অঞ্চলের সমস্ত নদী ও খাল এবং এর সংযোগ নদীসমূহ খনন করতে হবে।
১১. সমগ্র হাওর অঞ্চলের ফসল রক্ষা বাঁধ ও বেড়িবাঁধ (রাবার ড্যাম) যথাসময়ে এবং যথাযথভাবে নির্মাণ ও মেরামত।
১২. আইন করে দুর্দশাগ্রস্থ কৃষকদের জিম্মি করে গবাদীপশু, জমি কেনাবেচা (ডিস্ট্রেস সেল) ও দাদন ব্যবসা বন্ধ।
১৩. হাওর এলাকার জন্য পাহাড়ি ঢলের পূর্বেই তোলা যায় এমন ধান উদ্ভাবন (উৎপাদনে কম সময় লাগে এমন ধান) ও আবাদ।
১৪. একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিসহ হাওর অঞ্চলে নিম্ন আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে শিক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান।
১৫. হাওর অঞ্চলের শহরসমূহে বিকল্প কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা। ফসল তোলার সময় কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য ও ক্ষেতমজুরদের সারা বছরের কাজের নিশ্চয়তা দেওয়া।
১৬. হাওর অঞ্চলে ধান ও মৎস প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রকল্প গড়ে তোলা।