বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) আয়োজিত সমাবেশে নেতৃবৃন্দ গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অবসান ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে এগিয়ে আসতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। নেতৃবৃন্দ জুলাই-আগস্ট-এর অভ্যুত্থানে নিহত-আহতদের প্রকৃত তালিকা তৈরি, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে ভয় ও অপমানের রাজনীতির অবসান ঘটানোর আহ্বান জানান।
নেতৃবৃন্দ বলেন, গণতান্ত্রিক সংস্কারের কার্যক্রম শুরু ও নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের মধ্য দিয়ে জনগণের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই সময়ের দাবি। এই কাজে দৃশ্যমান ভূমিকা পালনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি নেতৃবৃন্দ আহ্বান জানান।
আজ ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, বিকাল ৪টায় জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার; জনজীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনা; সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণা; পাচারের টাকা ফেরত ও খেলাপী ঋণ আদায়; ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য, মন্দির-মাজার এবং নারীর ওপর হামলাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি; সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধ এবং পাহাড়ে হামলা বন্ধের দাবিতে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সিপিবি সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে নেতৃবৃন্দ এই আহ্বান জানান।
সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ। এসময় উপস্থিত ছিলেন-সিপিবি’র কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য শাহীন রহমান ও পরেশ কর এবং সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ফজলুর রহমান, অধ্যাপক এম এম আকাশ, ক্বাফি রতন, কাজী রুহুল আমিন, ডা. সাজেদুল হক রুবেল, জলি তালুকদার, আসলাম খান, লুনা নূর, হাফিজুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক ইদ্রিস আলী, মোসলেউদ্দিন, হাসিনুর রহমান রুশো প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারের ৪০ দিন পার হলেও এখনো মধুচন্দ্রিমা কেটেছে বলে মনে হচ্ছে না। তারা এখনো নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারল না। সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করতে পারল না। দখলদারিত্ব চাঁদাবাজি থেকে দেশকে মুক্ত করে ভয়ের রাজত্বের অবসান ঘটাতে দৃশ্যমান রূপরেখাও সামনে আনতে পারল না। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা, নির্বিঘ্নে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বিষয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন এলাকায়, পার্বত্য এলাকায় যে হত্যাকাণ্ড ভাঙচুর সংগঠিত হলো তা মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এর আগে সংগঠিত ভাঙচুর চাঁদাবাজির ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় মানুষের উদ্বেগ কমছে না। এসব ঘটনায় দেশি-বিদেশি নানা অপশক্তি নানামুখী কার্যক্রম করারও সুযোগ পাচ্ছে। অন্যদিকে ছাত্র রাজনীতি বন্ধসহ বিরাজনীতিকরণের নানা অপচেষ্টার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, সরকার কী করছে, কী করতে চায়? এসব কথা দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, রাজনীতিবিদরা জানেন না। নেতৃবৃন্দ প্রশ্ন করেন, তাহলে কাদের সাথে কথা বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ চালাচ্ছে? দেশবাসী তা জানতে চায়।
নেতৃবৃন্দ বলেন, এই সরকারকে মনে রাখতে হবে, তারা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকার নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে একটি গ্রহণযোগ্য শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আয়োজন করবে। একইসঙ্গে দীর্ঘদিনের জমে থাকা স্বৈরাচারী ব্যবস্থার উচ্ছেদের জন্য বেশ কিছু জায়গায় সংস্কারের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব উত্থাপন করে, পারলে ওইসব কাজের সূচনাও করবে। বাকি কাজ সম্পন্ন করবে নির্বাচিত সরকার। এসব কাজ করতে হবে রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে। এসব কাজে জনগণের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য জনজীবনের শান্তি ফিরিয়ে আনাকেই অন্যতম কাজ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও, বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনরা গত ৫৩ বছরে মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমতায় থাকার খুঁটি হিসেবে অনেক সময় ব্যবহার করা হয়েছে। এই সুযোগে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ারও দুঃসাহস দেখাচ্ছে। কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী অবস্থানকে দেশবাসী গ্রহণ করবে না।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন অব্যাহত রেখে ভালো রাজনীতি আশা করা যাবে না। দেশে মুক্তবাজারের নামে লুটপাটের চলমান অর্থনীতি এই সংকটের গোড়ার কথা। দুর্নীতি-লুটপাট আজ এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দুর্নীতি ও লুটপাটের যেসব খবর বেরোচ্ছে তা দেশবাসীর কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু চলমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনরা নিজেদের স্বার্থে আইন করে, কমিশন ভোগ করে, চাঁদাবাজি করেই তারা তাদের অর্থ সম্পদ গড়ে তুলেছে, টাকা পাচার করেছে। এরা দেশকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেই নিজেদের আবাসভূমি গড়ে তুলেছেন। আজ তাই এমন নীতি করতে হবে যাতে করে, উৎপাদনের সাথে জড়িত নয়, এমন জনগোষ্ঠী কখনোই অর্থ সম্পদের মালিক হতে পারবে না। তাহলে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা যাবে। এদেশে কমিউনিস্টরা এজন্যই দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে চলেছে।
নেতৃবৃন্দ দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা অনেক পরিবর্তন করেছেন, দেখেছেন, কিন্তু মানুষের মুক্তি আসেনি। যেসব রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দের ওপরে অধিকাংশ দেশবাসী ভরসা করেছে তারাই নিজেদের স্বার্থে নীতিহীন রাজনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে। আবার এর বিপরীতে বিরাজনীতিকরণের ধারাকে সামনে আনতে অনেকেই চেষ্টা চালিয়েছে। মানুষের মুক্তি আনতে গেলে এই দুই পথের অবসান ঘটাতে হবে। নীতিহীন রাজনীতি, বিরাজনীতিকরণকে ‘না’ বলে, নীতি-নিষ্ঠ রাজনীতিকে ‘হ্যাঁ’ বলে তার পতাকা তলে সমবেত হতে হবে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, জুলাই-আগস্ট এর গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা যাতে কোনোভাবে হাইজ্যাক না হয়ে যায় তার জন্য দেশবাসীকে সচেতন থাকতে হবে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে নিজ নিজ দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সিপিবি এবং বামপন্থীরা জনগণের পাশে থেকে এই সংগ্রামকে এগিয়ে নেবে।
সমাবেশ শেষে একটি মিছিল রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুরানা পল্টনস্থ পার্টির কার্যালয় এসে শেষ হয়। এছাড়াও সিপিবির আহ্বানে আজ দেশের বিভিন্ন জেলায় সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।