আগামীকাল ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, ঢাকা জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি, প্রখ্যাত শ্রমিকনেতা, অগ্নিযুগের বিপ্লবী, বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড সুনীল রায়ের জন্মশতবার্ষিকী। ১৯২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার শ্যামগ্রামে মহান এই বিপ্লবী জন্মগ্রহণ করেন।
সিপিবি’র সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড মোহাম্মদ শাহ আলম এক বিবৃতিতে কমরেড সুনীল রায়ের জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, কমরেড সুনীল রায় অনুকরণীয় ও অনুস্মরণীয় এক মহান বিপ্লবী। সারাজীবন শ্রমিক-মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য তিনি লড়াই করে গেছেন। শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি তথা মানব মুক্তির লড়াইয়ে তাঁর অবদান ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। শ্রমিক-জনতার লড়াইয়ে তিনি পথ দেখাবেন।
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, কমরেড সুনীল রায় ছিলেন স্পষ্টভাষী, আন্তরিক ও অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল মানুষ। যে কারণে সবাই তাকে আপন করে নিত। শত অত্যাচারের মুখেও কমরেড সুনীল রায় লড়াই অব্যাহত রেখেছিলেন। সাহস, সততা, নিষ্ঠার সঙ্গে লড়াই পরিচালনার জন্য বৃহত্তর ঢাকার সকল কারখানার শ্রমিকদের কছে সুনীল রায় জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন।
বিবৃতিতে সিপিবি’র নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, বাস্তবিক কর্তব্য পালন ছাড়া প্রচলিত সমাজ ভাঙা যাবে না। সবাইকে কমরেড সুনীল রায়ের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে শোষণমুক্ত সমাজ কায়েমের সংগ্রামকে অগ্রসর করতে হবে।
কমরেড সুনীল রায়ের জন্মশতবার্ষিকীর কর্মসূচি
কমরেড সুনীল রায়ের জন্মশতবার্ষিকীতে আগামীকাল ১৩ সেপ্টেম্বর সকাল ১০-৩০ মিনিটে পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তাঁর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হবে। এছাড়া রাত ৮টায় কমরেড সুনীল রায় স্মরণে সিপিবি’র উদ্যোগে অনলাইন আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে।
কমরেড সুনীল রায়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী
কমরেড সুনীল রায় ১৯২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার শ্যামগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা দেবেন্দ্র রায় এবং মা শষীবালা রায়। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। নবীনগরের এম কে মাধ্যমিক স্কুলে পড়া অবস্থায় ১৩/১৪ বছরে বাড়ি থেকে পালিয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে চিত্তরঞ্জন কটন মিলে তাঁত শ্রমিক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৩৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হওয়ার প্রায় সমকালীন সময় থেকে কমরেড সুনীল রায় কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের সংস্পর্শে আসেন।
১৯৪২ সালে কমরেড সুনীল রায় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করলেন। সেই সময় কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়। কমরেড সুনীল রায় শ্রমিকদের অর্থনৈতিক বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনের একজন সামনের সারির নেতা হয়ে ওঠেন। যার জন্য ১৯৪২ সালে তাঁকে জেলে যেতে হয়। চার বছর পর ১৯৪৬ সালে মুক্তি পান তিনি। ১৯৪৭ সালেই মিল কর্তৃপক্ষ আফসার উদ্দিন নামে আরেক শ্রমিকনেতাসহ তাঁকে চাকুরিচ্যুত করলে লাগাতার আন্দোলন, ধর্মঘট শুরু হয়। যা আশপাশের কারখানাগুলোতেও ছড়িয়ে পরে। আন্দোলন দমনের জন্য পুলিশ গুলি চালালে ৮ জন শ্রমিক নিহত হয়।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দমন পীড়নের ফলে কমিউনিস্ট ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দ আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। আত্মগোপন অবস্থায় ১৯৫০ সালে দ্বিতীয় দফায় গ্রেফতার হন কমরেড সুনীল রায়। মুক্তি পান ১৯৫৩ সালে। মুক্তি পেয়ে আদমজী জুট মিলে চাকুরি নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত থাকলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের হয়ে কাজ করেন। ৪ জুলাই ১৯৫৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে কমরেড সুনীল রায় অন্য কমরেডদের সাথে আত্মগোপনে চলে যান। ১৯৬০ সালে তাঁকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়। চার বছর জেল খেটে ১৯৬৪ সালে তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে তিনি নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলন গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যূত্থানের পূর্বেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি আবার আত্মগোপনে চলে যান। তিনি এক সময় নারায়ণগঞ্জের সুতাকল পাটকলগুলোতে শ্রমিক আন্দোলন, রাজনৈতিক সামাজিক আন্দোলনের প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে কমরেড সুনীল রায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর ক্যাম্পে ছিল তাঁর অন্যান্য সাধারণ ভূমিকা। ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ গেরিলা বাহিনীর শত শত মুক্তিযোদ্ধা এই এলাকা থেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ব্যবস্থার বিপর্যয়ের পর ১৯৯৩ সালে সিপিবি’র অভ্যন্তরে সৃষ্ট বিলোপবাদী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা কমরেড সুনীল রায় ছিলেন দৃঢ়। ১৯৯৩ সালে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। মৃত্যুকালে তিনি পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন।
২০০১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ৮১ বছর বয়সে কমরেড সুনীল রায়ের জীবনাসান ঘটে।