
অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটির আহ্বানে আজকের মহাসমাবেশ ও লাল পতাকার মিছিলে উপরোক্ত মন্তব্য করেন জাতীয় কমিটির অন্যতম আহ্বায়ক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিকের সভাপতি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মহাসমাবেশে বক্তব্য রাখেন, তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশল শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সিপিবি’র সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদ (মার্কসবাদী)’র আহ্বায়ক মবিনুল হায়দার চৌধুরী, বাসদ-এর সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, জাতীয় গণফ্রন্টের আহ্বায়ক টিপু বিশ্বাস, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক, গণমুক্তি ইউনিয়নের নাসিরউদ্দিন নাসু, গরিব মুক্তি আন্দোলনের শামসুজ্জামান মিলন, বাসদ (মাহবুব)’র শওকত হোসেন। সমাবেশ পরিচালনা করেন জাতীয় কমিটির সমন্বয়ক সিপিবি‘র প্রেসিডিয়াম সদস্য হায়দার আকবর খান রনো।
সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ১২টি রাজনৈতিক দল, ১৬টি শ্রমিক সংগঠন, ১১টি কৃষক-ক্ষেতমজুর সংগঠন, ৩২টি সাংস্কৃতিক সংগঠন, ৭টি ছাত্র সংগঠন, ৭টি নারী সংগঠন, একাধিক যুব ও শিশু-কিশোর সংগঠন অক্টোবর বিপ্লব

শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটির কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত।
সভাপতির ভাষণে ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক বাংলাদেশের বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের গরিব-মেহনতি মানুষের অবস্থার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
সমাবেশে স্বাগত বক্তব্যে জাতীয় কমিটির অন্যতম আহ্বায়ক ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমাদের এই উদ্যাপনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রীরা একত্র হয়েছেন। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনরত শ্রেণী ও পেশার সংগঠনগুলোও ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচী পালন করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছে নারী, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। উদ্যাপন রাজধানীতে যেমন তেমনি দেশের সর্বত্রই ঘটেছে। সমাজতন্ত্রের পক্ষে একটি নবজাগরণের আভাস পাওয়া গেছে। আমরা আশা করবো সমাজতন্ত্রীদের এই নৈকট্য স্থায়ী ঐক্যে পরিণত হবে এবং পুঁজিবাদ-বিরোধী সংগ্রাম নতুন বেগ ও গভীরতা পাবে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমরা যে লড়াই করছি তা একটি রাজনৈতিক লড়াই। অক্টোবর বিপ্লবও একটি রাজনৈতিক লড়াই। সেই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল তা ছিল একটি সামাজিক বিপ্লব। বিপ্লব হলো পুরানো রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে চুর্ণবিচূর্ন করা। বিপ্লবের পর লেনিন তাই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরনের ডাক দিয়েছিলেন। সমস্ত ক্ষমতা ছিল সোভিয়েতের হাতে। সোভিয়েত ছিল জনগণের হাতে। যে সময়ে আমরা অক্টোবর বিপ্লব পালন করছি,

সে সময়ে পুঁজিবাদ ফ্যাসিবাদের রূপ নিয়েছে। এই ফ্যাসিবাদকে উচ্ছেদ করতে হলে রাজনৈতিক লড়াই প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় এসেছে। তারা ক্ষমতাশীল হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে রাষ্ট প্রতিষ্ঠা করলাম সে রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়নি। বড় রাষ্ট ভেঙ্গে ছোট রাষ্ট হয়েছে। ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হয়েছে, পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ হয়েছে। মুক্তিুদ্ধে দুই লক্ষ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পরবর্র্তীতে রাষ্ট্র তাদের বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছে। সেই উপাধি পরবর্তীতে তাদের জন্য অসম্মানের প্রতীক হয়েছে। এ ছিল ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। এই বীরাঙ্গনা উপাধি প্রমাণ করে তাদের প্রতি রাষ্টের দৃষ্টিভঙ্গি।
তিনি সমাজে নারীর অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমরা আজকে যে সমাজে বাস করছি সেখানে নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, শিশুরা ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় নারী ও শিশু ধর্ষণ-নির্যাতন ছিল না। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা। ফলে এখানে যে নারী সর্বোচ্চ পদ লাভ করে সেও পিতৃতন্ত্রের শিকার হয়। সমাজতন্ত্র এই পিতৃতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছিল। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। আমাদের সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। শোষণ বন্ধ হয়নি। অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষে আমরা শোষণমুক্তির সংগ্রাম অব্যাহত

রাখব, শোষণ মুক্তির লড়াই চলবে।
তিনি বলেন, বৈজ্ঞানিক নিয়মে পুঁজিবাদের বিনাশ হবে। পুঁজিবাদের বিনাশ মানে ব্যক্তি মালিকানার সমাপ্তি। আগামীর ভবিষ্যৎ হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানার পৃথিবীর পরিবর্তে সামাজিক মালিকানার মানবিক বিশ্ব গড়ার।
তেল-গ্যাস জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন এবং মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এক ও অভিন্ন। কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন করছে। এই আন্দোলনকে শোষণমুক্তির আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে হবে।
সিপিবি সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দেখিয়েছিল শ্রমিক কৃষকের রাষ্ট্র কতটা মানবিক হয়ে উঠতে পারে। আজ সারা দুনিয়ার মানুষ দেখছে পুঁজির উন্মত্ততা, মানুষের অসহায়ত্ব, বিপুল বৈষম্য। সমাজতন্ত্র থেকে যারা সরে এসেছিলেন তাদের চেহারাও উন্মোচিত হয়েছে আজ। কিন্তু শোষণ-লুণ্ঠন আর দুর্দশাই শেষ কথা নয়। অক্টোবর বিপ্লব পথ দেখিয়েছে শোষণ মুক্তির। বাংলাদেশেও শ্রমিক শ্রেণি ঐক্যবদ্ধভাবে সে পথে চলবে। তিনি আরো বলেন, সমাজতন্ত্রকে অনিবার্য করে তোলার জন্য আজ লড়াই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। মুনাফা বনাম মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে সমাজতন্ত্রই সঠিক পথ।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, বঙ্গভবনের চুড়ায় লাল পতাকা উড্ডীন করার মধ্য দিয়ে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষকে

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে হবে। এই লড়াইয়ে সকল বামপন্থী নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নিতে হবে। নেতারা ঐক্য ভাঙতে চাইলেও কর্মীদেরকে ঐক্যবদ্ধ থেকে ‘বামঐক্য’কে চোখের মণির মত লালন করতে হবে।
বাসদ (মার্কসবাদী)’র আহ্বায়ক মুবিনুল হায়দার চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশে বিপ্লবের জন্য কমিউনিস্ট ঐক্যের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
বাসদ এর সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, অক্টোবর বিপ্লবের পথে এদেশের শ্রমিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে শ্রেণি সংগ্রামের চেতনা লালনকারী সকল বামপন্থী দল ও সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। এই লড়াই সংগ্রামের পথ ধরে বাংলাদেশে শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণ করাই আমাদের লক্ষ্য।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সাইফুল হক বলেন, সোভিয়েতের পতনের ফলে সারা পৃথিবীর মানুষকে আজ চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। নৈতিকতার অধঃপতন ঘটেছে। এই নৈতিকতা মনুষ্যত্বের মর্যাদা দেয় না। মুনাফা সবর্স্ব এ সমাজ মানবিক বোধগুলিকে পদদলিত করছে।
মহাসমাবেশ শেষে একটি বিশাল লাল পতাকা মিছিল শহীদ মিনার থেকে বের হয়ে দোয়েল চত্বর, জাতীয় প্রেসক্লাব, পুরানা পল্টন মোড়, জিরো পয়েন্ট, গোলাপ শাহ মাজার, নগর ভবন, কার্জন হলের সামনে দিয়ে দোয়েল চত্বরে এসে শেষ হয়। মিছিলে হাজার হাজার কণ্ঠে পুঁজিবাদী শোষণের অবসান ঘটিয়ে মানবিক-সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান ধ্বনিত হয়।