Revolutionary democratic transformation towards socialism

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট ভাঙা, উৎপাদক ও ক্রেতা সমবায় গড়ে তোলা সারাদেশে রেশন ব্যবস্থা চালুসহ বিকল্প প্রস্তাব তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলন


[২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ॥ সকাল ১১টা ৩০মি. ॥ মৈত্রী মিলনায়তন, মুক্তিভবন, ঢাকায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সিপিবি’র কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এম. এম আকাশ। সিপিবি সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বক্তব্য রাখেন ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এ সময় সিপিবি’র সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ, প্রেসিডিয়াম সদস্য শাহীন রহমান, সম্পাদক অ্যাড. আনোয়ার হোসেন রেজা, কোষাধ্যক্ষ ডা. ফজলুর রহমানসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।]

সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ
শুভেচ্ছা জানবেন। আপনারা জানেন, বর্তমান সরকারের দুঃশাসনের অবসান, জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ব্যবস্থা বদলের সংগ্রামে আমরা প্রতিনিয়তই রাজপথে রয়েছি। এই দুঃশাসনের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। দিন দিন অসহায় মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সরকার দাম বেঁধে দিয়েও ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে’ ব্যর্থ হচ্ছে। ঔষুধ, পানি, গ্যাস সর্বত্র নৈরাজ্য চলছে।

সরকারের নীতিই এই সংকট তৈরি করেছে। এর অবসানের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

আমরা তাই, চলমান দুঃশাসন হটানোর সাথে সাথে ব্যবস্থা বদলের সংগ্রাম অগ্রসর করতে দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়ে আসছি।

আজকের এই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানত দেশে দ্রব্যমূল্য নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।

বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি-ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া

বাজারে গেলে মানুষ এখন আর হাসিমুখে ঘরে ফিরতে পারেন না। প্রতি মুহূর্তে তিনি টের পাচ্ছেন যে তার টাকার দাম কমে গেছে। যে হারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে সে হারে আয় বৃদ্ধি পায়নি। ফলে বাজেট থেকে প্রথমে শখের পণ্য, পরে প্রয়োজনীয় পণ্য ছেঁটে ফেলে কায়ক্লেশে জীবন ধারণ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। 

অথচ অন্যদিকে এই করোনাকালেই কোনো কোনো লোকের আয় অত্যন্ত দ্রুত লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ডের পরিসংখ্যান অনুসারে বিলিওনেয়ার ক্লাবে এক বছরেই নতুন করে বাংলাদেশের ২৬ জন যোগ দিয়েছেন।

বি.আই.ডি.এস এবং সানেমের জরিপ অনুসারে বাংলাদেশে করোনাকালে দারিদ্র্যসীমার নিচে যারা নেমে গিয়েছিলেন তারা এখন পর্যন্ত সবাই দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে আসতে পারেন নি। আমরা তাই আবার ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ দারিদ্র্যের হারের মধ্যেই আছি। সরকারের কমিয়ে দেয়া ২০ শতাংশকেই যদি হিসাবে ধরি তাহলে এখন এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি লোক প্রয়োজনীয় ক্যালরির খাবার পাচ্ছেন না। এদের কথা সরকার, শাসকগোষ্ঠী ও মুনাফালোভীরা ভাবছে না।

আমাদের করোনা থেকে উদ্ধার সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ভেতরে এবং বাইরে কয়েকটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করেছে।

প্রথম: আমাদের ধনী লোকরা দেশের ভেতরে বিনিয়োগ করছেন না। তাদের অনেকের সম্পদ দেশের বাইরে পাচার হয়েছে, হচ্ছে। দেশের চেম্বারগুলির নেতারা এর বিরুদ্ধে বলেন কিন্তু নিজেরা সুযোগ পেলে কি করবেন তা বলা কঠিন। প্রায় প্রতিটি আমদানি পণ্যের দাম বেশি করে দেখিয়ে (Overinvoicing) মূল্যবান ডলার বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে রপ্তানি পণ্যের দাম কৃত্রিমভাবে চুক্তি করে কম দেখিয়ে (Underinvoicing)-বাড়তি ডলার আয় বিদেশেই রেখে দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশের ধনীরা বিদেশে ভোগ-বিলাস এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ক্রয়ে হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করছেন, কেউ কেউ বিদেশে বিনিয়োগ করে ডলার উপার্জনও করছেন- কিন্তু এগুলি কিছুই দেশে ডলারের রির্জাভ বাড়াচ্ছে না। সরকার ১ টাকার মেগা প্রজেক্টে ৩ টাকা ব্যয় করছেন। সে জন্য চীন, জাপান, ভারত, আই.এম.এফ থেকে প্রচুর ডলার ঋণ নিতে হচ্ছে। শীঘ্রই এসব ঋণ শোধের জন্য সরকারকে ডলারের রির্জাভ থেকে ডলার দিতে হবে। সম্প্রতি বিদেশে অবস্থানরত দরিদ্ররা বর্ধিত বাজার বিনিময় হারের সুযোগ নেয়ার জন্য হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে শুরু করেছেন। এর ফলে এসব ডলার শেষ পর্যন্ত কোথায় আছে তার হিসাব মিলছে না।

সরকার উদারভাবে জনগণের টাকা থেকে ঋণ নিয়েছে। ব্যক্তিখাতকেও বৃহৎ ঋণ দিয়েছে। সুদের হার দীর্ঘদিন নয়-ছয়-এ সীমাবদ্ধ রেখেছে। তাতে কি হয়েছে। ৯ শতাংশ হারে ঋণ নিয়ে সেই ঋণ তারা শোধ করতে পারছেন না, অনেকে শোধ করছেন না। ফলে খেলাপীঋণ জমা হচ্ছে। নতুন উৎপাদনশীল ছোট পুঁজিপতিরা ঋণ বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকার এখন নতুন করে হরে-দরে Leanding Rate বাড়াতে চাচ্ছেন। সরকারের যুক্তি হচ্ছে যেহেতু এখন জিনিসপত্রের দাম শতকরা ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। সেহেতু ৯ শতাংশ সুদ নিলে আসলে ঋণগ্রহীতার ১ শতাংশ প্রকৃত লাভ থেকে যাবে। সরকার যে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের উপর মাত্র ৬ শতাংশ সুদের হার ধরে রেখেছিলেন, তাতে যে তাদের ইতোমধ্যে ৩ শতাংশ লস হয়ে গেল সেটা কে ভাববে?

আমাদের দেশ অনেকগুলি পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এমনকি কৃষিখাতে আমরা অনেকগুলি পণ্য প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারলেও বাজারে তাদের দামের কোনো আগা-মাথা পাওয়া যায় না। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দাম বেড়ে গেলে সরবরাহ বেড়ে যায় এবং দাম কমে আসে। আমাদের এখানে অর্থনীতির এই চিরায়াত নিয়মের কোনো প্রতিফলন বাজারে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে না।

৫টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম সরকার উৎপাদন খরচ ও নর্মাল মুনাফা হিসাব করে খুচরা ভোক্তামূল্য নির্ধারণ করে সম্প্রতি তা ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারের নির্ধারিত দাম লংঘন করে সিন্ডিকেট, অসাধু ব্যবসায়ী  ও Speculative Trader (ফাটকা কারবারি) দের কারসাজির কারণে এসব পণ্যের দাম বাড়ছে। গত ১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২৩ প্রথম আলোর রির্পোট অনুসারে বাস্তব পরিস্থিতিটা নিম্নরূপ-
তালিকা-১

 পণ্যের নাম
সরকার নির্ধারিত দাম  
বাজার দর 
পার্থক্য

আলু৩৫-৩৬.০০
৪৫-৫০.০০৩৮% বেশি
পেঁয়াজ
৬৪-৬৫.০০৮৫-৯০.০০২৪% বেশি
ডিম
৪৮.০০
 ৫০-৫২.০০
৮% বেশি
সয়াবিন তেল১৬৯.০০
১৭০-১৭৪.০০৩% বেশি
খোলা চিনি
১৩০.০০১৩৫-১৪০.০০
৮% বেশি
এছাড়া সিলিন্ডার গ্যাস, যা এখন দেশের মানুষের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়েছে, তা নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না। এসব পণ্যের বেঁধে দেওয়া দাম যে বাস্তবতার তুলনায় অনেক বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব নিয়ে আগে যে গণশুনানী হতো, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের স্বার্থে তা বাদ দেওয়া হয়েছে।
উপরোক্ত তালিকা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি  সয়াবিন তেল ও খোলা চিনির চাহিদা সম্ভবত: ৮ শতাংশ দাম বাড়ার কারণে চাহিদা কমে গিয়ে এবং আমদানিকৃত সরবরাহ কিছুটা অক্ষুণ্ন রেখে বা দেশের উৎপাদন অব্যাহত রেখে এ ক্ষেত্রে সংকট কিছুটা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কতকাল? আর ঐ দাম তো সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে নেই।

শ্রীলংকার শিক্ষা

শ্রীলংকার উদাহরণ থেকে আমরা জানি যে একসময় করোনাকালে সেখানে ট্যুরিজম থেকে ডলার আয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রেমিট্যান্সও কমে গিয়েছিল। বিদেশি ঋণ শোধ করতে গিয়ে প্রচুর ডলার বেরিয়ে গিয়েছিল। ইউক্রেন যুদ্ধের পর পেট্রোলের দাম যখন হু-হু করে বেড়ে গেল তখন শ্রীলংকা পুরো রির্জাভ খরচ করেও সব কূল রক্ষা করতে পারেনি। অন্যদিকে তথাকথিত “Organic চাষের” ব্যর্থ এক্সপেরিমেন্টের ফলে শ্রীলংকার অর্থনীতিতে নেমে আসে আক্ষরিকভাবে এক আঁধার। জ্বালানির অভাবে বিদ্যুত নেই, নিত্য খাদ্য পণ্যের ঘাটতির কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ বেড়ে যায়, পেট্রোল পাম্পে বিশাল কিউ সৃষ্টি হয়। এই অসহনীয় পরিস্থিতিতেও দেখা গেল অসৎ আমলা, অসৎ ব্যবসায়ী ও অসৎ রাজনীতিবিদরা জোট বেঁধে দুর্নীতি করছেন, বাজেটে ঘাটতি ব্যয় মেটানোর জন্য টাকা ছাপাচ্ছেন, মিথ্যা বাগাড়ম্বর করছেন- তখন সেখানে গণঅভ্যূত্থান সৃষ্টি হয়েছিল। জনতা প্রেসিডেন্ট প্যালেস আক্রমণ করে দখল করেছিল। পরে অবশ্য একই শ্রেণির অপেক্ষাকৃত সংস্কারপন্থী নতুন সরকার ক্ষমতা নেয় । আই.এম.এফ ও ভারত তখন ইমার্জেন্সি ডলার না দিলে শ্রীলংকা এই সংকট সামলাতে পারতো না। আমরা দেখতাম একটা Total chaos সামগ্রিক বিশৃংখলা।

কিন্তু এ কথাও সত্য, পরবর্তীতে শক্ত ঋণনীতি (Credit Policy), কঠোর সরকারি কৃচ্ছতা সাধন এবং পাশাপাশি গরিবদের জন্য অতিরিক্ত সামাজিক নিরাপত্তা তহবিল থেকে আপদকালীন নিরাপত্তা ব্যয় নির্বাহের মাধ্যমে তাদেরকে সক্ষম ও টিকিয়ে রাখার দ্বারা শ্রীলংকা আজ পুনরায় মুদ্রাস্ফীতি কমাতে ও ডলার রিজার্ভ ক্রমাগত বাড়াতে শুরু করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শ্রীলংকা ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং তা থেকে আমাদেরও কিছু শেখার আছে কিনা তা ভাবার সময় হয়েছে। এ কথা সত্য শ্রীলংকার অর্থনীতির সাইজ অনেক ছোট। জনসংখ্যাও অনেক কম। জনসম্পদও আমাদের চেয়ে অনেক শিক্ষিত ও উন্নত। মাথাপিছু আয়ও অনেক বেশি। আর আমাদের নিজস্ব রিজার্ভ পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত  শ্রীলংকার তুলনায় অনেক ভালো। আমরা সরকারের সরকারি ঋণগ্রহণ মাত্রার দিক থেকেও শ্রীলংকার থেকে অনেক ভালো অবস্থানে আছি। কিন্তু এ থেকে আত্মসন্তুষ্ট হওয়ার কোনো অবকাশ নেই।

জরুরি করণীয়
আমরা যদি হুন্ডি সংকটের মোকাবেলা করতে না পারি, ঘরের রেমিট্যান্স ঘরে আনতে না পারি এবং বাইরে ডলারের পাচার/বহির্গমন ঠেকাতে না পারি, পদে পদে দুর্নীতি ও অপচয় কমাতে না পারি, বাজেটের যথাযথ ব্যয় বৃদ্ধির জন্য আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা না করতে পারি, আয়কর ও সম্পদ-কর বাড়াতে না পারি এবং এসব কিছু মিলিয়ে ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে প্রায় ৪ কোটি দরিদ্র ও আরও ১০ কোটি নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তকে সামাজিক সুরক্ষা দিতে না পারি তাহলে তিলে তিলে আমরা কিন্তু ভবিষ্যতে এক মহাসংকটের দিকে এগিয়ে যাব। তখন সব দিক থেকে হয়তো ঢেউ এসে আমাদের বিপদে ফেলে দিতে পারে।

আমাদের যে করেই হোক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে হবে ও প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ও তার দক্ষ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। এই মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমালেও প্রয়োজনীয় আমদানি আমরা কমাতে পারবো না। প্রয়োজনীয় Food and Fuel আমদানির জন্য আমাদেরকে আজ নতুন ধরনের ভূরাজনৈতিক ডিলেও যেতে হতে পারে। এইবার আমরা ব্রিকসের ব্যাংকে যোগদান  করেছি। এটা কিছুটা নতুন ঋণের নতুন উৎস খুলে দিতে পারে। পক্ষান্তরে যদি আমরা ভুল বাজার নীতি ও কুশাসন, দুঃশাসন অব্যাহত রাখি, শ্রীলংকার মতো ঋণফাঁদে পড়ে যাই, তাহলে আমাদের মতো বৃহৎ অর্থনীতির জন্য সেখান থেকে আর বের হয়ে আসা খুবই কঠিন হবে। তাই আজ আমাদের একটি দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধের ও শক্তিশালী রিজার্ভ গঠনের প্ল্যান তৈরি করে এগুনো দরকার।
 
পাশাপাশি বর্তমান আপদকালীন সময়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্রদের ও নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তদের প্রত্যক্ষ সুরক্ষা প্রদান ও মুৎসুদ্দী ধনীকদের শৃংখলার মধ্যে নিয়ে আসতে বাধ্য করার মাধ্যমেই এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে।

গতানুগতিক অপ্রত্যক্ষ কায়দায় (ছোট খাট সুদের হার বাড়িয়ে বা টাকার বিনিময় হার একবারে বাজারে ছেড়ে দিয়ে) বা অপরিকল্পিতভাবে Supply Menagment (আমদানি বাড়িয়ে বা অন্য কোনো এডহক ব্যবস্থা) করে এ সংকট থেকে স্থায়ী পরিত্রাণ মিলবে না। বাজারভিত্তিক Incentive বা প্রণোদনার দ্বারা এ সংকট থেকে উত্তরণ হওয়া কঠিন যদিও গুডউইল দেখানোর জন্য সরকার তা করছেন বলে মনে হয়।

আমাদের কৃষি উৎপাদনে, পোশাক শিল্পে, রেমিট্যান্স ও ফরেন ইনভেস্টমেন্টে এই মুহূর্তে কোনো উল্লেখযোগ্য উল্লম্ফন (Quantum Jump) দেখা যাচ্ছে না। আর সেটার জন্য গণতন্ত্র, সুশাসন ও মৌলিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনাটা জরুরি।
 
এসব না করে প্রচলিত ব্যবস্থা বহাল রেখে (মুক্তবাজারের নামে সবকিছু বাজারের উপরে ছেড়ে দিয়ে, সিন্ডিকেট তোষণ করে) ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে হম্বি-তম্বি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে একবার যদি ব্যবসায়ীরা সব পণ্য আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যায় তখন খুবই বিপদ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে আছে এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে। অর্থাৎ অসৎ ব্যবসায়ী, অসৎ আমলা এবং অসৎ রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে যে ক্ষমতা কাঠামো গঠন করে শাসক শ্রেণি সমাজে তার শক্তি বিস্তার করে রয়েছে এবং তারই কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অস্বচ্ছতা ও জবাবাদিহিতার শূন্যতা বজায় রেখে নিজের বৈভব গড়ে তুলেছে- তারা খুব সহজে তাদের সুবিধাগুলি ছেড়ে দিবেন না। এটি একটি নতুন সামাজিক শক্তি বিন্যাস ছাড়া পুরোপুরি সম্ভব হবে না- তাই যারাই সংকট থেকে স্থায়ী মুক্তি চান তাদেরকে সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করতে হবে এখনই।

জনগণকে তাই এই মুহূর্তে সচেতন হয়ে নিজেদের উদ্যোগে নানারকম বিকল্প আন্দোলন ও ক্ষমতা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। খুচরা ডিম বিক্রেতা বা আলু পাইকার (যারা হিমাগারে কিছুটা লাভের আশায় speculative trade এর জন্য জমা করে রেখেছিলেন) বা খাতুনগঞ্জেব ছোট আড়তদারকে জবাবদিহিতার অধীনে আনতে হবে।

বড় আমদানি লবিকে ও ফিল্যান্স পুঁজিকে (সে এল.এন.জি লবি হোক বা বৃহৎ ঋণখেলাপী হোক, বা বিভিন্ন খাদ্য পণ্যের বিশাল হোলসেল আমদানিকারক হোক!) নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। জরুরি সংকট মোকাবিলায় এই মুহূর্তে সরকারের “Open market sales and open market buying” নীতি কার্যকর করতে হবে।

দরিদ্র ভোক্তাদের জন্য বিকল্প বাজার বা সরবরাহ উৎস তৈরি করা। এজন্য সর্বজনীন রেশনিং ব্যবস্থা ও সর্বত্র ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করতে হবে।

কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে ফসল তোলার মৌসুমে সরকার যদি এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ নিজেদের গুদামে বা হিমাগারে ধরে রাখতে পারেন (আলু, ধান, পাট, পেঁয়াজ ইত্যাদি) তাহলে দাম বাড়লে বাজারে বিক্রি ও দাম কমলে বাজার থেকে ক্রয়নীতি অবলম্বন করে কিছুটা অগ্রসর হতে পারেন। এই ধারাকে অগ্রসর করতে হবে। এতে Agricultural price commission  গঠন করে এর অধীনে একটা স্থায়ী ফান্ড গড়ে উঠতে পারে এবং সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম কমে যাবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বিকল্প মজুত, বিকল্প বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যাতে বাজারের সরবরাহ নিশ্চিত ও দাম নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এছাড়া দেশের কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত ও ভোক্তাদের নায্যমূল্যের পণ্য কেনা নিশ্চিত করতে উৎপাদন ব্যয় কমানো এবং উৎপাদক ও ভোক্তা সমবায় গড়ে তুলতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে গণবণ্টন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ঋণখেলাপীদের কাছ থেকে টাকা আদায় ও পাচারের টাকা ফেরত আনতে হবে। ঋণখেলাপীদের ঋণ না দিয়ে, সমবায় সমিতি বা Self-help group গড়ে তুলে তাদেরকে নিয়ে সামাজিক উদ্যোক্তা হিসাবে ঋণ দিয়ে এগিয়ে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

আমরা জানি, এই কর্মসূচির একটি রাজনৈতিক পূর্বশর্ত হচ্ছে অনুকূল শাসনক্ষমতা ও জনগণের সচেতন সংগঠিত প্রয়াস। তাই শুধু ভোটের জন্য নয়, শুধু ভাতের জন্য নয়, সম্পূর্ণ ব্যবস্থা বদলের জন্য তৃণমূল থেকে জনউত্থান ছাড়া এটা সম্ভব হবে না। কমিউনিস্ট পার্টি জনগণের আশু সংকট নিরসনের জন্য চলমান ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পাশাপাশি এই ধরনের মৌলিক গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য যুগপৎ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সাংবাদিক বন্ধুগণ
আজকের সংবাদ সম্মেলনে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা নিতে কি কি করা প্রয়োজন, সে বিষয়ে আমাদের কিছু প্রস্তাব আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে চাই।

সাধারণ মানুষের যুক্তিসঙ্গত আয় নিশ্চিত করার জন্য

১.     সংগঠিত, অসংগঠিত শ্রমিক, ক্ষেতমজুরদের জন্য যুক্তিসঙ্গত জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও তার প্রদান নিশ্চিত করা এবং মজুরি কমিশনের মাধ্যমে মজুরির হার নির্ধারণ করা। জাতীয় ন্যূনতম মজুরি এবং মজুরির হার বছর বছর এমনভাবে বৃদ্ধি করা যেন তা বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে বেশি হয়। 

২.     অনুরূপ নিয়মে কর্মচারীদের জন্য বেতন কমিশনের ব্যবস্থা করা। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত ১:৫ কিংবা নিদেনপক্ষে ১:৬ এর মধ্যে রাখা। 

৩.     ক্রমবর্ধমান ধনবৈষম্য ও শ্রেণিবৈষম্য নিরসনের অনুকূলে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য

১.     নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য, বিশেষত দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের জন্য স্থায়ী রেশন ব্যবস্থা চালু করা। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে ছবিসহ রেশন কার্ড প্রদানের ব্যবস্থা করা। এই দরিদ্র মানুষদের জন্য রেশনে কন্ট্রোল দামে চাল, গম, তেল, ডাল, চিনি এবং প্রয়োজনমতো অন্যান্য অত্যাবশ্যক পণ্য সাপ্তাহিকভিত্তিতে প্রদান করা। পর্যায়ক্রমে পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো।

২.     রাষ্ট্রীয় সহায়তায় ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করা এবং ক্রেতা-সমবায় সমিতি সংগঠিত করে দেশব্যাপী তার বিপণন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।

৩.   মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ থেকে উৎপাদক কৃষক ও ক্রেতাসাধারণকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সহায়তায় একদিকে ‘ভোক্তা সমবায় সমিতি’ এবং অন্যদিকে ‘উৎপাদক সমবায় সমিতি’ গড়ে তোলা এবং এই দুই সংস্থার মধ্যে সরাসরি সংযোগ ও লেনদেনের ব্যবস্থা করা।

৪.     বিএডিসির কার্যক্রমকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করে সারাদেশে সার, বীজ, কীটনাশক, সেচ যন্ত্রপাতিসহ কৃষি উপকরণ ন্যায্যমূল্যে এবং সময়মতো খোদ কৃষকের কাছে সরাসরি সরবরাহের ব্যবস্থা করা। যাতে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমে আসে।

৫.     পণ্য পরিবহনে দুর্নীতি, হয়রানি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা। একইসঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনসহ হাটবাজারে ইজারাদারি ব্যবস্থা ও তোলা আদায়ের অত্যাচার বন্ধ করা।

৬.     দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্তভাবে টিসিবির কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে অত্যাবশ্যক পণ্যসামগ্রীর আমদানি, মজুত ও সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখা।

৭.     রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে খাদ্যদ্রব্যসহ অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রীর বাফার স্টক গড়ে তোলা।

৮.    পাইকারি ও খোলাবাজারে পণ্যমূল্য তদারকির জন্য ‘মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ (Price Regulatory Authority) প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি উপযুক্ত ‘ক্রেতাস্বার্থ সংরক্ষণ আইন’ প্রণয়ন করা।

৯.     আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ওপেন মার্কেট সেল, মার্কেটিং অপারেশন, টেস্ট রিলিফ, কাজের বিনিময় খাদ্য (কাবিখা) প্রভৃতি কর্মসূচিসহ যে কোনো আপৎকালীন দ্রুততার সঙ্গে ‘ঝটিকা কার্যক্রম’ পরিচালনার প্রস্তুতি রাখা।

১০.    পৃথক মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মাধ্যমে গ্রাম-শহরসহ সারাদেশে সাশ্রয়ী, দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত ‘গণবণ্টন ব্যবস্থা’ (Public Distribution System) চালু করা।

১১.    বিলাসদ্রব্য আমদানি কিছু সময়ের জন্য নিষিদ্ধ করা।

১২.    পাইকারি ও খুচরা বাজারে রাষ্ট্রের প্রভাব-সক্ষমতা সৃষ্টি করা। একইসঙ্গে এ বাজারগুলোতে প্রত্যক্ষ রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের উপযুক্ত ব্যবস্থা ও কার্যক্রম চালু করা।

১৩.    বাজারের ওপর সিন্ডিকেট ও মুনাফা-শিকারি লুটেরাদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ খর্ব করা। ‘অবাধ খোলাবাজার অর্থনীতির’ দর্শন ও ‘মার্কেট ফান্ডামেন্টালিজম’-এর নীতি থেকে বের হয়ে আসা।

আন্দোলনের কর্মসূচি : ২৩, ২৪ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী বিক্ষোভ

এই সংবাদ সম্মেলন থেকে-
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, সিন্ডিকেট ভাঙা, সারাদেশে রেশন ব্যবস্থা, ন্যায্য মূল্যের দোকান চালুসহ উৎপাদক ও ক্রেতা সমবায় গড়ে তোলার দাবিতে আগামী ২৩ ও ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করছি।

প্রিয় বন্ধুগণ
আশা করি, আপনাদের লেখনীর মাধ্যমে দেশবাসী আমাদের বক্তব্য জানতে পারবেন এবং সচেতন ও সংগঠিত হয়ে দাবি আদায়ে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবেন।
 
এতক্ষণ ধৈর্য ধরে আমাদের বক্তব্য শোনার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন

Login to comment..