স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের মহান শহীদ কমরেড তাজুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি শাহ আলম বলেন, উচ্চ শিক্ষিত শহীদ তাজুলের রক্তদান দেশের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা।
তিনি বলেন, শোষণ-বঞ্চনা অব্যাহত রেখে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। এ জন্য আজ গণতন্ত্র ও সমাজ প্রগতির লড়াই বেগবান করে বিজয়ী হতে হবে। তিনি বলেন, দেশের মানুষ কষ্টে আছে। ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে আমরা জয়ী হলেও মানুষের মুক্তি আসেনি। দেশ আজ গণতন্ত্রহীনতার সংকটে পড়েছে। তিনি গণতন্ত্রের সংগ্রামে বিজয়ী হয়ে বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি সমাবেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
কমরেড শাহ আলম বলেন, শহীদ তাজুল শ্রমিকশ্রেণির মুক্তিকে চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে তৎকালীন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রামে নিয়োজিত হয়েছিলেন। এ সংগ্রামে তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আজ কমরেড তাজুলের আত্মত্যাগের ৩৯ বছর পরেও দেশের মানুষের ভোটের অধিকার এবং মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের সংগ্রামে শহীদ তাজুল সর্বদাই অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।
তাজুল স্মরণে পার্টির সভাপতি কমরেড মোহাম্মদ শাহ আলম আরো বলেন, শহীদ তাজুল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তাদের দোসরদের হাতে জীবন দিয়েছেন অথচ গণতান্ত্রিক দেশ প্রতিষ্ঠা করতে স্বৈরাচারের পতন হলেও প্রকৃত গণতন্ত্র আজও ফিরে আসেনি দেশে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে একটি সরকার গঠন হলেও তারা রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে এ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা ও গণতন্ত্রহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। দেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর সকল প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করে দলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে, নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ করে নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে বাম প্রগতিশীলদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের বিকল্প নেই, আর সেই বিকল্পের লড়াইয়ে সিপিবি শহীদ তাজুলের চেতনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, কমরেড তাজুলের রক্তদান ঐ সময়ে তরুণ প্রজন্মকে উজ্জীবিত করে মেহনতি মানুষের সংগ্রামে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছিল। তিনি বলেন, ৯০’র গণঅভ্যূত্থানের পরই শুধুমাত্র ক্ষমতালোভী দল ঐ চেতনা ভুলে ক্ষমতার খেলে মেতে ছিল। এরা তিন জোটের রূপরেখায় প্রণয়নে পর পর তিনটি নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এর বিধান মানে নি। রূপরেখা উল্লেখিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মদদ দেওয়া বন্ধ-প্রতিহত করা, স্বৈরাচার-রাজাকারদের প্রশ্রয় না দেওয়া, আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান এর কথা মানে নি।
তিনি বলেন, সরকার জনগণকে মূল্যবৃদ্ধির যাতাকলে
পিষ্ট করছে, আর ঘুষ-দুর্নীতি, লুটপাট, টাকা পাচারের স্বর্গরাজ্য বানিয়েছে। তিনি চলমান দুঃশাসন বিরোধী আন্দোলন জোরদার করে গণতন্ত ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
৩৯তম শহীদ তাজুল দিবসে আজ ১ মার্চ ২০২২, মঙ্গলবার পুরানা পল্টনে মুক্তিভবনের সামনে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের পর অনুষ্ঠিত সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সিপিবি সভাপতি কমরেড শাহ আলম এবং সাধারণ সম্পাদক কমরেড রুহিন হোসেন প্রিন্স এসব কথা বলেন। এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গণসংগঠন, পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ শহীদ তাজুলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
উল্লেখ্য যে, কমরেড তাজুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতক শেষ করে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সিদ্ধান্ত অনুসারে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির সংগ্রামকে অগ্রসর করার মহান ব্রত নিয়ে আদমজী মিলে বদলি শ্রমিকের চাকরি নেন। আদমজীতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তোলার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ছিলেন সিপিবি’র আদমজী শাখার সম্পাদক ও আদমজী মজদুর ট্রেড ইউনিয়নের নেতা।
১৯৮৪ সালের ১ মার্চ দেশব্যাপী আহূত শিল্প ধর্মঘট ও হরতালের সমর্থনে আগের দিন মধ্যরাতে আদমজী জুটমিল এলাকায় কমরেড তাজুলের নেতৃত্বে শ্রমিকরা প্রচার মিছিল বের করলে, তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের গুন্ডাবাহিনীর হামলায় কমরেড তাজুল ইসলামসহ কয়েকজন শ্রমিক মারাত্মক আহত হন।
১ মার্চ ভোরবেলা গুরুতর আহত অবস্থায় কমরেড তাজুলকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির কিছুক্ষণ পরে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
শহীদ তাজুল স্মরণে নির্মিত ‘অস্থায়ী শহীদবেদী’তে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের শ্রদ্ধা নিবেদন
আজ ১ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত কমরেড শহীদ তাজুল ইসলাম স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। বিভিন্ন দল, সংগঠনের পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনের মধ্য দিয়ে শহীদ তাজুলের স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী বেদী ফুলে ফুলে ভরে যায়। প্রথমেই সিপিবি’র কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন।
এরপর একে একে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাম গণতান্ত্রিক জোট, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাসদ (মার্কসবাদী), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতি, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি), সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, সাপ্তাহিক একতা, বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়ন, সিপিবি’র বিভিন্ন জেলা ও থানা শাখাসমূহের নেতৃবৃন্দ।