প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ
শুভেচ্ছা জানবেন।
নির্বাচন কমিশন আহূত মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র অংশগ্রহণ না করা এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পর্কে সিপিবি’র বক্তব্য আপনাদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের ও দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।
শুরুতেই আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আপনারা অবগত আছেন যে, আজ ২৮ জুলাই বেলা ২.৩০ মি. এ নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশন সিপিবি প্রতিনিধিদের মতবিনিময়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এজন্য আমরা নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যুক্তিসংগত কারণে আমরা এই মতবিনিময়ে যাওয়ার প্রয়োজন মনে না করায় সভায় উপস্থিত হইনি।
প্রথমত
এ ধরনের মতবিনিময়ে সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো যুক্তিযুক্ত হতো বলে আমরা মনে করি। নির্বাচন কমিশন এটা করেনি। এ ধরনের মতবিনিময় সভায সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা না থাকায় মতবিনিময় বিশেষ কোন ফল আনবে বলে আমরা মনে করি না।
দ্বিতীয়ত
প্রাপ্ত আমন্ত্রণ পত্রে বলা হয়েছে, “সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা রয়েছে, যা সময়ের সাথে সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে। এছাড়াও নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সহ বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে।”
নির্বাচন কমিশনের এসব কথার মধ্য দিয়ে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা পর্যাপ্ত ও ইভিএম মেশিনের ব্যবহারকে প্রশ্নাতীত করে তোলা হয়েছে। অথচ ইভিএম মেশিন ব্যবহারে অধিকাংশ অংশীজন একমত হয়নি।
আমরা মনে করি, নির্বাচন নির্বাচন কমিশনের এই মতবিনিময় ‘নিছক অন্যদের কথা শোনা ও নিজেদের কথা গেলানোর চেষ্টা’ ছাড়া কিছুই করবে না। তাই এই মতবিনিময়ে অংশগ্রহণের প্রয়োজন আমরা মনে করিনি।
আমরা মনে করি জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সুষ্ঠু ও অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান শুধু প্রত্যাশা নয়, যে কোনো মূল্যে আগামী নির্বাচনকে জনগণের অংশগ্রহণে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে নিশ্চিত করতে হবে।
এজন্য সিপিবি দীর্ঘদিন লড়াই করছে। ২০০৭ সালে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন এর সাথে সংলাপে সিপিবি’র বক্তব্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত বইয়ে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো এসব বিষয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য আমরা এখনও জানতে পারিনি।
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরলেও এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য বা সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা করতে নির্বাচন কমিশনের কোনো উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়েনি।
সিপিবি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির প্রবর্তন, নির্বাচনের সব প্রচার প্রচারণার দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে পালন করা, ‘না’ ভোট পুনঃপ্রচলন, জনপ্রতিনিধি প্রত্যাহার এর বিধান, নির্বাচনকে টাকা-পেশি শক্তি, সাম্প্রদায়িক প্রচার-প্রচারণা ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ মুক্ত করতে নানা পদক্ষেপ নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে নির্বাচনকালীন সময়ের সরকারের ভূমিকা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিশ্চিত করা ছাড়া এখনকার বাস্তবতায় দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সম্ভাবনাই নেই।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘অবাধ-নিরপেক্ষ’, সুষ্ঠু-গণতান্ত্রিক ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য সিপিবি’র প্রস্তাব
ভূমিকা
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য অত্যাবশ্যক শর্ত হলো একটি স্বাধীন, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, পেশাদার, দক্ষ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন। কিন্তু একথাটিও সত্য যে, প্রয়োজন হলেও সেটুকুই তার জন্য যথেষ্ট নয়। তার জন্য সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো--গোটা নির্বাচন-ব্যবস্থাকে সর্ম্পুণরূপে ঢেলে সাজানো। প্রয়োজন, 'সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। প্রয়োজন, নির্বাচনকে অর্থ, পেশিশক্তি, প্রশাসনিক কারসাজি, সাম্প্রদায়িক প্রচারনা ইত্যাদি থেকে মুক্ত করা। এসব ক্ষেত্রে আমুল সংস্কার সাধন করা ব্যতীত একটি 'সর্ব্বোউৎকৃষ্ট' নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে 'অবাধ-নিরপেক্ষ' নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার যেন কোন প্রকারে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করার সাংবিধানিক রক্ষা কবজ থাকাও অপরিহার্য । নির্বাচন রাতের অন্ধকারে প্রশাসনের সরাসরি সহযোগিতায় কেন্দ্র দখলের মাধ্যমে যেভাবে তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, তাতে করে প্রশাসন নিরপেক্ষ ভোট বিষয়টি নিশ্চিত করা আজ একান্তভাবে প্রয়োজন।
অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং সেজন্য একটি যথোপযুক্ত নির্বাচন-ব্যবস্থা ও তার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা 'রাজনৈতিক-গণতন্ত্রের একটি আবশ্যিক শর্ত ৷ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার জন্য প্রত্যেক নাগরিকের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা এবং অবাধ-ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত ইচ্ছা ও মতামতের প্রতিফলন নিশ্চিত করা- এগুলো হলো একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ নির্বাচনের প্রাথমিক ও মৌলিক উপাদান। এসবের নিশ্চয়তা প্রদান করাই হওয়া উচিত নির্বাচন কমিশনের মূল দায়িত্ব।
কিন্তু আমাদের দেশের জনগণকে এই ন্যূনতম সুযোগটি থেকেও বার বার বঞ্চিত করা হয়েছে। বর্তমানে শাসকশ্রেনির “মুক্তবাজার অর্থনীতি'র দর্শনের ভিত্তিতে পরিচালিত লুটপাটের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনুষঙ্গ হিসেবে নির্বাচন বহুলাংশে এক “টাকার খেলা”, ‘পেশিশক্তির প্রতিযোগিতা, প্রশাসনিক কারসাজি ও সাম্প্রদায়িকতা ও বিভাজন সৃষ্টিরঅগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে । গরিব শ্রমজীবী মানুষসহ বিত্তহীন,স্বল্পবিত্ত সাধারন মানুষের পক্ষে নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দি¦তার সুযোগকে কার্যত অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। জনমত নয়, অর্থ-অস্ত্রের ব্যবহার প্রশাসনিক সহযোগীতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে পুজি করে নির্বাচন পরিচালনা ও তার ফলাফল নির্ধারণ প্রতিদিনের নিয়মে পরিনত হয়েছে। নির্বাচনের নামে কোটিপতিদের প্রতিযোগিতার এই খেলায় 'জনগণের প্রকৃত ইচ্ছা ও মতামত প্রতিফলনে'র কোনো সুযোগ আর থাকছে না। নির্বাচন আজ নানাভাবে বস্তুত এক ধরনের প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থা থেকে নির্বাচনকে মুক্ত করা ও রক্ষা করা নির্বাচন কমিশনের কাজ।
এমতাবস্থায় অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে (১) একটি স্বাধীন, দক্ষ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন (২) নির্বাচনকালীন সরকার (৩) নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া এবং (৪) নির্বাচন-ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো--এই চারটি বিষয় সম্পর্কে আমরা আমাদের নি¤œ লিখিত কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করছি ।
নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে সুপারিশসমূহ
(ক) ১. সংবিধানে নানা নির্দেশনা অনুসরন করে ইসির কাজ সংবিধানে নির্দেশিত ক্ষমতা প্রয়োগ এবং স্বচ্ছতা স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরনে বিধানাবলি সংযোজন করা।
২. সংবিধানের ১১৯ (২) (রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত ) ১২৬ (“নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করা সকল নির্বাহী কতৃপক্ষের কর্তব্য হইবে”) এর নির্দেশনা প্রয়োগের জন্য বিধি বিধান যুক্ত করা।
৩. নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান যুক্ত করা।
৪. নির্বাহী কতৃপক্ষ আদেশ নির্দেশ যদি না পালন করেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
খ. নির্বাচন কমিশনকে আর্থিকভাবে পরিপূর্ণ স্বাধীন করতে হবে এবং এ জন্য বাজেটে এমনভাবে সরাসরি বরাদ্দ প্রদান করতে হবে যাতে ওই অর্থ পর্যাপ্ত হয়, এবং তা ছাড় করার ব্যাপারে নির্বাহী বিভাগের কোনো কর্তৃত্ব না থাকে।
গ. নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন সংস্থা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের সচিবালয়ের কাজ নিশ্চিত করা এবং তাকে স্বতন্ত্র টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাসহ আধুনিক ব্যবস্থাদিতে সজ্জিত করা। নির্বাচন কমিশনই তার কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগ দেবেন। নির্বাচন কমিশনকে সব সময়, বিশেষ করে নির্বাচনের সময়, জনপ্রশাসন থেকে যথেষ্ট সংখ্যক জনবল ও পর্যাপ্ত সম্পদ সরবরাহ করা।
ঘ. নির্বাচন কমিশনকে ”রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার” এবং নির্বাচনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী নিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া। নির্বাচনকালীন সময় নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যেন প্রকৃত ও পরিপূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকেন- তা নিশ্চিত করা। এ সময়কালে নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারী’রা কোনো অপরাধ বা কর্তব্যে অবহেলা করলে, সে জন্য নির্বাচন কমিমিশন আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। সংবিধান অনুযায়ী সরকার ও প্রশাসন তা অনুসরণে বাধ্য থাকবেন।
ঙ. নির্বাচনী বিধি প্রণয়নের অধিকার নির্বাচন কমিশনের থাকবে।
চ. নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনের জন্য নির্বাচন কমিশন নির্বাচন বাতিলসহ আইন লঙ্ঘনকারীদের আটক ও কারাদ- প্রদান করতে পারবেন।
নির্বাচনকালীন সরকার
ক. নির্বাচন পরিচলনার জন্য নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তদারকি সরকার গঠন করতে হবে।
খ. এই লক্ষ্যে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে হবে। ওই সময়ের কাজ সুনির্দিষ্ট করতে হবে ।
জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চলমান জাতীয় সংসদ ভেঙে দিতে হবে।
১) সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন:
ক. জাতীয় সংসদকে হতে হবে প্রধানত জাতীয় নীতি-নির্ধারণ ও আইন প্রণয়ন করার এবং রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাজ-কর্ম তদারক করার সংস্থা। সংসদ সদস্যগণ স্থানীয় উন্নয়ন কাজ, প্রশাসনিক অথবা এ ধরনের স্থানীয় অন্য কোনো কাজের সঙ্গে থাকতে পারবেন না, তারা গুধু জাতীয় নীতি-নির্ধারণ, আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাজ কর্ম তদারক করা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। স্থানীয় সব উন্নয়নমূলক ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাজ কর্ম সেই এলাকার নির্বাচিত স্বশাসিত স্থানীয় সরকারের নিয়ন্ত্রনে পরিচালিত হবে। এই ব্যবস্থার ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থার ও প্রশাসনের গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকারের প্রকৃত ক্ষমতায়ন এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রে তৃণমূলে জনগনের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ গভীরতর করা সহজতর হবে । এই লক্ষে জাতীয় সংসদে এলাকা ভিত্তিক একক প্রতিনিধিত্বের বদলে জাতীয় ভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। এজন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে হবে।
খ. এরূপ 'সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব' ব্যবস্থা অনুযায়ী নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদের নিজস্ব এখতিয়ারভূক্ত কাজ-কর্ম সম্পর্কে নীতি-কর্মসূচি-প্রস্তাবনা পরিকল্পনা বর্ণনা করে রাজনৈতিক দলগুলো দেশবাসীর সামনে নিজ নিজ ইশতেহার উপস্থিত করবে। দেশবাসী এসব ইশতেহারের-মধ্যে থেকে যে দলের ইশতেহারে তাঁদের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে পাবে, সেই দলের মার্কায় ভোট দেবে যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই দল জাতীয় সংসদে তত শতাংশ সংখ্যক প্রতিনিধি পাঠাবে ।
ঐকমত্যের প্রযয়োজনে নতুন 'সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের পাশাপাশি বর্তমান 'এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব 'ব্যবস্থাও আংশিকভাবে (অর্ধেক আসনে) অব্যাহত রাখা যেতে পারে। (সকলের মতামতের ভিত্তিতে এই অনুপাত কম-বেশি করা যেতে পারে ।)
গ. ইশতেহার ঘোষণার পাশাপাশি প্রতিটি রাজনৈতিক দল সংসদে আসন নেয়ার জন্য নির্বাচনের আগেই তাদের দলের অগ্রাধিকারক্রম অনুসারে প্রতিনিধিদের তালিকা দেশবাসীকে জানিয়ে দেবে । নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোট অনুসারে যে কয়টি আসন সেই দলের প্রাপ্য হবে, তালিকার ক্রমানুসারে সেই কয়জন ব্যক্তি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত বলে গণ্য হবেন !
এক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীদের পৃথক দুটি তালিকা করতে হবে। সংসদে নারী ও পুরুষ সদস্যদের সংখ্যার একটি নির্দিষ্ট অনুপাতের বিধান করা হবে এবং নির্ধারিত সেই অনুপাত মোতাবেক দুটি তালিকা থেকে নাম নিয়ে তাদেরকে নির্বাচিত বলে গণ্য করা হবে।
ঘ. এই ব্যবস্থায় সংসদ সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কাজে দলীয় প্রধানের বা নেতৃত্বের কোটারীর স্বেচ্ছাচারিতার আশঙ্কা রোধ করার জন্য দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা বিধিবদ্ধভাবে বাধ্যতামূলক করা হবে। স্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে তা নিশ্চিত করার দাযত্বি দেওয়া হবে।
২) নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করার জন্য
রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ প্রদান করে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় বহনের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এ ব্যবস্থা চালু করা পুরোপুরি এখনই সম্ভব না হলে :
ক. একজন প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়ে সর্বোচ্চ সীমা কমিয়ে ৩ লাখ টাকা নির্ধারণ করতে হবে। মনোনয়ন পত্র জমা দেয়ার খরচ বিশ হাজার টাকা করতে হবে।
খ. প্রার্থী নিজে বা প্রার্থীর পক্ষে অন্য কেউ, যারা যেভাবেই নির্বাচন কাজে অর্থ ব্যয় করুক, তা প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং কোনোক্রমে নির্বাচনী ব্যয়ের সীমা লঙ্ঘন করতে দেয়া হবে না। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় নির্ধারিত একজন কর্মকর্তাকে এই ব্যয় মনিটর করতে হবে এবং তাঁকে নির্বাচন কমিশনের কাছে সে সম্পর্কে নিয়মিতভাবে প্রত্যাহিক রিপোর্ট দিতে হবে। এই রিপোটের সঙ্গে প্রার্থীর দেয়া নির্বাচনী ব্যয়ের বিবরণ মিলিয়ে দেখতে হবে।
গ. প্রার্থীর নির্বাচনী আয়-ব্যয়ের বিবরণ সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে উন্মুক্ত দলিল হিসেবে রাখতে হবে এবং প্রচারমাধ্যমকে তা সরবরাহ করতে হবে। এ বিষয়ে যে কোনো ভোটারের আপত্তি জানানোর সুযোগ রাখতে হবে।
ঘ. নির্বাচনী কাজে আয়-ব্যয়ের হিসাব ২১ দিনের মধ্যে জমা দিতে হবে এবং তা করতে না পারলে অথবা নিরীক্ষা করে তা ভ্রান্ত বলে প্রতীয়মান হলে নির্বাচিত সদস্যের শপথ গ্রহণ বন্ধ রাখতে হবে। ওই বিবরণীর যথার্থতা যাচাইয়ের দ্রুত ও উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
ঙ. নির্বাচন কমিশনের কাছে আয়-ব্যয় ও সম্পদের মিথ্যা তথ্য প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। সংসদ সদস্য বা যে কোনো জনপ্রতিনিধি মিথ্যা তথ্য দিলে তার সদস্যপদ বাতিল ঘোষিত হওয়ার বিধান যুক্ত করতে হবে।
৩) প্রার্থীদের সম্পদ ও পরিচয় প্রকাশার্থে
ক. প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগেই তার নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের সম্পদের বিবরণ, কোনো রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে তার স্বার্থ জরিত আছে কি না ইত্যাদি সম্পর্কে বিবরণ দাখিল করতে হবে ।
খ. প্রার্থীদের কোনো অপরাধের রেকর্ড আছে কিনা তা নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে।
গ. নির্বাচন কমিশনকে এইসব তথ্যের সত্যতা যথাসম্ভব যাচাই করে তা জনগণকে অবহিত করার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ভোটাররা প্রার্থীর, যোগ্যতা-অযোগ্যতা সম্পর্কে অবগত থাকেন।
৪) প্রার্থী মনোনীত হবার যোগ্যতা নির্ধারণে
ক. রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন-প্রার্থী হতে হলে, তাকে কমপক্ষে ৩ বছর দলের সদস্যপদ নিয়ে এবং জনগণকে অবহিত রেখে দলের কর্মকা-ে অংশ নিতে হবে।
খ. স্বাধীনতাযুদ্বের 'বিরোধীতাকারী বা যুদ্ধাপরাধী হলে, নিজে অথবা পরিবারের কেউ ঋণখেলাপী কিংবা ঋণখেলাপীর জামিনদার হলে, কালো টাকার মালিক বলে বিবেচিত হলে, সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ অথবা চাকুরিচ্যুতির বছর ৩ বছর অতিক্রম না করলে, কোন ব্যক্তি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না । স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রেও এই বিধি প্রযোজ্য হবে।
গ. দলের মনোনয়নপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে তৃণমূল থেকে স্বচ্ছ মনোনয়ন প্রক্রিয়া ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে ও দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ এবং মনোনয়নপ্রাপ্তির জন্য অর্থ দ্বারা প্রভাবিত করার ঘটনা কার্যকরভাবে রোধ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫) ভোটার তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে পূর্ণ-স্বচ্ছতা বজায় রাখতে ও সকলের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে:
ক. ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রচারমাধ্যমে লাগাতার প্রচার করতে হবে এবং ক্রস চেকিং ব্যবস্থাসহ ভোটার তালিকা প্রতিনিয়ত নবায়ন করার স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। কম্পিউটারাইজড ভোটার তালিকা ও ভোটারদের জন্য আইডি কার্ডের ব্যবস্থা ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
খ. 'পার্বত্য শান্তি চুক্তি' অনুযাযী যথাযথ নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে নিশ্চিত করতে হবে।
গ. প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণ ও তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে ।
ঘ. প্রবাসী, কারারুদ্ধ ও নিজ ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে কর্তব্যরত ভোটারদের জন্য পোস্টাল ব্যালট প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬) নির্বাচনকে সন্ত্রাস, পেশিশক্তির প্রভাব ও দুর্বৃত্তমুক্ত করতে
ক. নির্বাচনে সকল প্রকার বল প্রয়োগ, অস্ত্র বহন ও প্রদর্শন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং এ ধরনের ঘটনায় কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে।
খ. কোনো প্রার্থী অথবা রাজনৈতিক দলের পক্ষে পেশিশক্তির মহড়া, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শন, নির্বাচনী কাজে সন্ত্রাসী-অপরাধী ব্যক্তিকে ব্যবহার ইত্যাদি কঠোরভাবে রোধ করতে হবে।
৭) নির্বাচনে ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা ও আঞ্চলিকতার অপব্যবহার রোধ করতে:
ক. নির্বাচনে ধর্মের সর্বপ্রকার অপব্যবহার ও সাম্প্রদায়িক প্রচার-প্রচারণার ভিত্তিতে ভোট চাওয়া নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।
খ. ধর্মীয় উপাসনালয়, মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, মঠ, ওয়াজ মাহফিল, ধর্মসভা ইত্যাদি স্থান বা অনুষ্ঠানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কোনো প্রকার নির্বাচনী প্রচার না চালানো, পোস্টার. হ্যান্ডবিল ইত্যাদি বিলি নিষিদ্ধ করতে হবে।
গ. 'আঞ্চলিকতা'র ধুয়া তুলে প্রচারণা ও ভোট চাওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে:
৮) নির্বাচনে সকলের সম-সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
ক. পোস্টার, লিফলেট, বৈদ্যুতিক বিজ্ঞাপন, মাইক, নির্বাচনী ব্যানার, 'দেওয়াল লিখন, গেইট নির্মাণ ইত্যাদি বিষযয়ে যেসব নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা আছে তা ব্যতিক্রমহীনভাবে পালন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকেই 'সুয়ামটো' ব্যবস্থা নিতে হবে। তফসিল ঘোষণার আগে এ ধরনের প্রচারণা চালানোর বিষযয়ে ও বিধিবিধান প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে।
খ. নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার দিন থেকে বিশেষ দায়িত¦ প্রাপ্ত স্থানীয় নির্বাচনী কর্মকর্তার মাধ্যমে সকল প্রার্থী ও দলের সমাবেশ, মহাসমাবেশ, র্যালি, জনসভা ও অন্যান্য সকল নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে আচরণবিধি ও অন্যান্য বিধি-বিধান মেনে চলা হচ্ছে কিনা তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনিটরিং ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
গ. নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী বিধিবিধান সংক্রান্ত সভার আয়োজন করবে।
ঘ. রেডিও-টিভিতে প্রচারের সময়কে সমানভাবে বণ্টন এবং এজন্য ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন খরচের উপর নিযয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে ।
ঙ. এসব প্রতিটি বিষযয়ে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং লঙ্ঘনকারীদের প্রার্থীতা বাতিল করাসহ কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
চ. যে কোনো প্রার্থীকে যে কোনো সংখ্যক আসনে প্রতিদ্বন্দিতা করার সুযোগ পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে।
৯) প্রতিনিধি প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা প্রবর্তন:
ক. নির্বাচিত প্রতিনিধি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে, এলাকার জনগণ প্রয়োজনে যাতে ওই প্রতিনিধি প্রত্যাহার করতে পারে--তার বিধান প্রবর্তন করতে হবে।
১০) 'না' ভোট
ক. প্রার্থী বা দলের কেউ সমর্থনযোগ্য নয় বলে কারো কাছে বিবেচিত হলে, সেক্ষেত্রে 'না' ভোট প্রদানের বিধান ও ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১১) রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করতে:
ক. নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের গণতান্ত্রিক বিধি-বিধানের ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া, দলের কর্মকর্তাদের নিয়মিত নির্বাচন, দলের আর্থিক বিবৃতি নির্বাচন কমিশনকে প্রদান ইত্যাদি বাধ্যতামূলক করতে হবে। এসব বিষয়ে যাচাইয়ের ব্যবস্থা ও কোনোরূপ লংঘনের ঘটনায় শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা গ্রহণের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
খ. নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনের ব্যাপারে রাজনৈতিক কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
১২) নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণে ও নির্বাচন পরিচালনায় স্বচ্ছতা বিধানে:
ক. যতদিন ও যেসব ক্ষেত্রে 'সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা' প্রবর্তন না হচ্ছে ততদিন নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণের জন্য প্রকাশ্য শুনানীর ব্যবস্থা আরো স্বচ্ছ, উন্মুক্ত ও কার্যকর করতে হবে।
খ. সাধারণভাবে ভোটারের সমসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করতে হবে ।
গ. প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারি প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের তালিকা এবং ভোট গ্রহণ কেন্দ্রের তালিকা নির্বাচনের কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগেই দল অথবা প্রার্থীদেরকে সরবরাহ করতে হবে, যাতে এ বিষয়ে কোনে আপত্তি উঠলে তা নির্বাচনের আগেই নিষ্পত্তি করা যায়।
১৩) নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা ও সে সম্পর্কিত বিরোধ নিরসন:
ক. ভোট কেন্দ্রে সকলের উপস্থিতিতে নির্বাচনের ভোট গণনা ও তার ফলাফল ঘোষণা এবং উক্ত ফলাফলের স্বাক্ষরিত কপি দল
অথবা প্রার্থীর মনোনীত ব্যক্তিকে প্রদান করতে হবে।
খ. নির্বাচনের ফলাফল কেবল নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করবেন।
গ. নির্বাচনী ফলাফল সম্পর্কে কোনো বিরোধের ক্ষেত্রে হাইকোর্টে চাকুরিরত বা অবসওে আছেন এমন বিচারপতির নেতৃত্তে গঠিত নির্বাচনী ট্রাইবুনালে সে বিষয়ে নির্বাচনী মামলা দুই মাসের মধ্যে মীমাংসার ব্যবস্থা এবং এতদসংক্রান্তে কোনো আপীল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ব্যাঞ্চ কর্তৃক তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে।
১৪) রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী কর্তৃক আচরণবিধি অনুসরণ নিশ্চিত করতে:
ক. নির্বাচনী আচরণ বিধিতে যা রয়েছে তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে তার জন্য অঙ্গীকার ও সহযোগীতা প্রদান করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা প্রদানের জন্য কেন্দ্র ও জেলা পর্যায়ে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করতে হবে।
খ. অভিযোগ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে, নির্বাচন কমিশনকে নিজ নিজ দায়িত্বে মনিটরিং ও অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে আচরণ বিধি অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে।
১৫) নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন-ব্যবস্থা প্রবর্তন।
ক. সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সরাসরি ভোটে নির্বাচন-ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
ইভিএম প্রসঙ্গে
১) কমিউনিস্ট পার্টি মনে করে ইভিএম (EVM) ছিনতাই (Hacking) বা, টেমপার (Tempering) করা সম্ভব।
২) সারা পৃথিবীতে এ পদ্ধতি এখনো অনুসৃত হচ্ছে না। যদি কোন কারণে ইভিএম মেশিন নষ্ট হয় তাহলে পুরো তথ্য মুছে যায় যা ফেরত আনার আর কোন সুযোগ থাকে না। বাংলাদেশে এর ব্যবহার উপযোগিতা সীমাবদ্ধ, কারণ বিরাট সংখ্যক ভোটার এ ধরণের কারিগরি ইলেট্রনিক যন্ত্র ব্যবহারে অভ্যস্ত নয়।
৩) ইভিএমে কোন ধরণের ইন্টারনেট, ব্লুটুথ বা ওয়াই ফাই সংযোগ সম্পুর্ন নিষিদ্ধ, কিন্তু বাংলাদেশে সে ধরণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই।
৪) মাইক্রোকন্ট্রোলারের প্রোগ্রাম পরিবর্তনের সুযোগে কোন কেন্দ্রে সকল প্রার্থী একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক (২০ বা ৫০ বা ১০০) ভোট পাবার পর যে কোন ব্যালট বাটনে চাপলেই অতিরিক্ত ভোট দখলকারী প্রার্থীর প্রতীকে যুক্ত হবে, এমন প্রোগ্রামও লিখে ব্যালট ছিনতাই সম্ভব।
৫) যদি নির্বাচনী কর্মকর্তার স্মার্ট কার্ডের নকল কার্ড তৈরি করা হয় এবং তা যদি ইভিএমের প্রোগ্রামকে বিভ্রান্ত করে একবারে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোট কাস্ট করে দেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন হয়, তাহলে তা নির্বাচনের ফলাফলকে সম্পুর্ণরুপে পাল্টে দিবে।
৬) মাইক্রোকন্ট্রোলার চিপ নিয়ন্ত্রিত এই ইভিএমের প্রতিটি স্মার্টকার্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে আরএফআইডি ( রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন) ট্যাগ। অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতা পেলে কোন প্রার্থীর কর্মীরা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে কয়েকশ মিটার দূর থেকেও কন্ট্রোল ইউনিট নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে।
৭) বাংলাদেশে ব্যবহৃত ইভিএমে কোন Voter Verifiable Paper Audit Trail (VVPAT) নেই । যার ফলে কোন ধরণের জালিয়াতি বা আপত্তি উঠলে ভোট পুনঃগণনার সুযোগ নেই।
৮) তাছাড়া অনেক সময় ভোটারের আঙ্গুলের ছাপ ইভিএম মেশিন চিনতে না পারলে অনেকে ভোট দানে বঞ্চিত হয়।
৯) এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তার হাতে বিশ শতাংশ ভোট বসিয়ে দেয়ার ক্ষমতা সংরক্ষিত আছে। বর্তমানে নির্বাচনী কর্মকর্তারা দলীয় সুবিধাভোগী হওয়ায় এ ধরণের কর্মকর্তাদের কাছে ভোটবুথের বিশ শতাংশ ভোট দিয়ে দেয়ার ক্ষমতা মারাত্বক ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে পুরো ফলাফলে কারচুপি হওয়ার সরাসরি ঝুঁকি থেকে যায়।
১০) ইভিএমে যে সফ্টওয়্যার ব্যবহার করা হয় তা পরিবর্তন করে অসাধু গধষধিৎব প্রতিস্থাাপন করে কারচুপির মাধ্যমে ফলাফল নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব।
১১) বাংলাদেশে ভোটাররা বিষয়টিতে অভ্যস্ত নয় তাই এতে বেশি সময় প্রয়োজন হয়। যার ফলে দীর্ঘ সময় লাইনে দাড়াঁতে হয় এবং ভোটাররা অনুৎসাহিত/নিরুৎসাহিত হয়ে ফিরে যান।
১২) ইভিএম মেশিন তাদের আঙুলের ছাপ চিনতে না পারার ঘটনা ঘটে ও তারা ভোটদানে বঞ্চিত হন এবং তাদের অন্যতম মৌলিক অধিকার ভোটদান থেকে তারা বঞ্চিত হন, যা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের চরম লঙ্ঘন।
১৩) বাংলাদেশে বর্তমানে পনের লক্ষ ইভিএম রয়েছে। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী সকল সংসদীয় এলাকায় চল্লিশ হাজার একশ নিরানব্বইটি ভোট কেন্দ্রে ইভিএম নিশ্চিত করতে হলে পয়তাল্লিশ লক্ষ ইভিএম মেশিনের প্রয়োজন । যে সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই।
১৪) বাংলাদেশে প্রশাসনের চরম দলীয়করণ হওয়াতে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা আশা করা বাতুলতা। তাই ইভিএম মেশিনে সফ্টওয়ার পরিবর্তন করে দেয়ার বড় সম্ভাবনা রয়েছে।
১৫) বাংলাদেশ নির্বচন কমিশনের ইভিএম পরিবীক্ষণ করার কোন অনুসরনের (বা ট্রাকিং) সফ্টওয়্যার নেই। যেসব যানবাহনে ইভিএম পরিবহন করা হয় সেগুলোতে কোন জিপিএস (এচঝ) ব্যবহার করা হয় না। ভারতের নির্বাচন কমিশন ইভিএম পরিবহন, স্থাাপন, ও ব্যবহারের পুরো প্রক্রিয়াটি ভিডিও ধারণ করে থাকে। যা অবশ্য করণীয় । বাংলাদেশে এ ধরণের সতর্কতামূলক নিরাপত্তা পদক্ষেপ সম্পূর্ন অনুপস্থিত।
১৬) এখানে প্রাসঙ্গিক হওয়াতে উল্লেখ্য যে জার্মানীর উচ্চ আদালত ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করেছেন। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে বলা হয় যে সফটওয়্যারের ত্রুটি বা ইচ্ছাকৃত জালিয়াতি সঠিক সময়ে চিহিৃত করা দুরুহ। তাই এসব বিষয় প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাা ছাড়া ইভিএম ব্যবহারে অগ্রসর হওয়া সংবিধানে প্রদত্ত জনগনের ভোটের অধিকার স্বচ্ছতার সাথে প্রয়োগের পরিবেশ রক্ষার পরিপন্থী।
১৭) পৃথিবীর সাতশ কোটি জনসংখ্যার পঞ্চাশ ভাগের বেশি বর্তমানে ইভিএম ব্যবহার করছে না।
১৮) এসব সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন দেশ যথা জার্মানী, বৃটেন, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, স্পেন ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট আয়োজন করা থেকে বিরত রয়েছে। তাই এ ধরণের পটভুমি ও পরিস্থিাতিতে আগামী নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহারে আমরা সম্পুর্ণ বিরোধী।