Revolutionary democratic transformation towards socialism

বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রতিনিধি দলের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন, পূজারী, পুরোহিত, আক্রান্ত ও নিহত আহতদের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথাবলা-মতবিনিময়ের অভিজ্ঞতা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা ও আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য


প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আজকের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার জন্য বাম গণতান্ত্রিক জোট কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের পক্ষ থেকে আপনাদেরকে জানাই সংগ্রামী শুভেচ্ছা।

সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আপনারা সবাই অবগত আছেন যে, বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দূর্গা পূজার অষ্টমী দিনে গত ১৩ অক্টোবর ২০২১ তারিখে অর্থাৎ ১২ অক্টোবর দিবাগত ভোর রাতে কুমিল্লার নানুয়ার দিঘীর পাড়ের পূজা মন্ডপে দেবীর কোলে কে বা কারা মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘কোরান’ রেখে দেয়। সকালে পুরোহিত ও পূজারী কেউ মন্দিরে পৌঁছার আগেই এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা উস্কে দিয়ে মতলববাজ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী পূজা মন্ডপে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটায়। এবং সারা দেশে ফেসুবুক ইউটিউবের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উস্কে দেয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ঐদিনই কুমিল্লায় বেশ কয়েকটি মন্দির ও পূজা মন্ডপে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঘটনার পর প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ৪/৫টি মন্দিরে পূজা বন্ধ করে দেয়া হয়। যা অত্যন্ত নিন্দীয়। এই ঘটনার জেরে একই দিনে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জেও ৫/৬টি মন্দির ও পূজা মন্ডপ ভাংচুর, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনা দ্রুত সিলেট, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, সিরাজগঞ্জ, কক্সবাজারসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মন্দির ও পূজা মন্ডপে হামলা ভাংচুর লুটপাট অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে থাকে। দশমীর দিনে ১৫ অক্টোবর নোয়াখালীর চৌমুহনীতে বিসর্জনের পরেও পূজা মন্ডপে, মন্দিরে ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়ীঘর দোকানপাটে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ ঘটায়, নারীদেরকে নির্যাতন করে। সনাতন ধর্মাবলম্বী অন্তত ৩ জনকে পিটিয়ে হত্যা করে। পূজা শেষেও পরদিন ১৬ অক্টোবর ফেনী, ১৭ অক্টোবর রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। রংপুরের পীরগঞ্জে জেলে পল্লীতে আগুন ধরিয়ে ২৫টি বাড়ী পুড়িয়ে দেয় এবং ৪০/৫০টি বাড়ীতে ভাংচুর, লুটপাট করে পরিবারগুলোকে সর্বশান্ত করে ফেলে।

সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে বাম গণতান্ত্রিক জোট ১৩ তারিখেই গণমাধ্যমে বিবৃতি প্রদান করে এবং ১৪ অক্টোবর ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। এবং ১৭ অক্টোবর ২০২১ রবিার বাম জোটের একটি প্রতিনিধি দল সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কুমিল্লা, হাজীগঞ্জ ও চৌমুহনীতে পূজা মন্ডপ, মন্দির, বাড়ীঘর, সরেজমিন পরিদর্শন করে এবং আক্রান্ত ও আহত নিহতদের পরিবারবর্গের সাথে কথা বলেন ও মতবিনিময় করেছেন।
বাম জোট কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের সমন্বয়ক ও বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ এর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন বাম জোটের কেন্দ্রীয় নেতা সিপিবি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য কমরেড আব্দুল্লাহ আল কাফি রতন, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক কমরেড মোশাররফ হোসেন নান্নু, বাসদ (মার্কসবাদী)’র কেন্দ্রীয় নেতা কমরেড মানস নন্দী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য কমরেড আকবর খান ও গণসংহতি আন্দোলনের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য কমরেড বাচ্চু ভুইয়া। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের সাথে হাজীগঞ্জে যুক্ত হন চাঁদপুর জেলা বাম জোটের নেতা বাসদ (মার্কসবাদী) আহ্বায়ক কমরেড আলমগীর হোসেন দুলাল, বাসদ সমন্বয়ক কমরেড শাহজাহান তালুকদার, সিপিবি সাধারণ সম্পাদক কমরেড জাকির মিয়াজি, গণসংহতি আন্দোলনের ইয়াসিন প্রধান; চৌমুহনীতে যুক্ত হন বাম জোটের নেতা সিপিবি সভাপতি কমরেড শহীদ উদ্দিন বাবুল, সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের ভূইয়া, বাসদ জেলা সমন্বয়ক খায়ের ইমতিয়াজ মাসুদ দাউদ, বাসদ (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক বিটুল তালকুদার, বাসদ নেতা আবদুর রাজ্জাক, ডা. হারাধন চক্রবর্ত্তী, এড. মিলন মন্ডল, অর্জুন দাস; কুমিল্লায় সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পরেশ কর, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জুলকারনাইন ইমন, বাসদ নেতা ফারজানা আক্তার, নাসিরুল ইসলাম মজুমদার ও মুক্তিযোদ্ধা জনাব বাবুল। পরিদর্শন টিমের অভিজ্ঞতায় প্রকৃত ঘটনা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে এবং আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করার জন্য আজকের এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।

সংবাদিক বন্ধুগণ,
ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়া এবং থাকার জন্য সাম্প্রদায়িকতাকে নানা সময়ে উস্কে দিয়েছে এবং ব্যবহার করেছে। যা আজও অব্যাহত আছে।

বাম জোটের প্রতিনিধি দলটি ১৭ তারিখ সকাল সাড়ে সাতটায় ঢাকা থেকে গাড়ীযোগে যাত্রা করে সকাল দশটায় হাজীগঞ্জে পৌছাঁই। সেখানে প্রথমে রামকৃষ্ণ আশ্রম পরিদর্শন করি। আশ্রমের পুরোহিত সেবাময়ানন্দ, পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক, স্থানীয় সাংবাদিক ও জনসাধারণের সাথে কথা বলে জানা যায় কুমিল্লার ঘটনার পর হাজীগঞ্জে রাত ৮:৪০ মিনিটে প্রথমে ৩০/৪০ জনের একটি গ্রুপ তৌহিদী জনতার নামে মিছিল করে আশ্রমের গেটে এসে তা-ব শুরু করে এবং ৩/৪ বার শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা মিছিল করে এবং লোকসংখ্যা বেড়ে ৪০০/৫০০ জন হয়, পরে তা আরও বাড়তে থাকে। এরপর তারা কাঠের গুড়ি দিয়ে আশ্রমের গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে ভাংচুর, লুটপাট শুরু করে। আশ্রমের স্কুলও ভাংচুর করে। রাস্তায় মেয়েদেরকে লাঞ্ছিত করে, অলংকার ছিনিয়ে নেয়।

পুরোহিত বলেন, প্রথমে মিছিলকারীরা এসে তা-ব চালালে সাথে সাথে থানায় ফোন করে জানানো হয়। কিন্তু ঘটনার দেড়-দুই ঘণ্টা পর ৫/৭ জন পুলিশ এসেই ১০ মিনিট পরে আবার চলে যায়। স্থানীয় সিভিল প্রশাসনের ইউএনও পরের দিন ফোন করে জিজ্ঞসা করে তোমাদের ওখানে কিছু হয়েছে কিনা? জেলা প্রশাসনের কর্তারা ডিসি, এসপি ঘটনাস্থলে আসে ২ দিন পর ১৫ অক্টোবর। পুরোহিত আরও বলেন, স্থানীয় হামলাকারীরা গেটের বাইরে থাকে এবং দূরের লোকজনকে ভিতরে তা-বের জন্য পাঠায়। তিনি আরও বলেন, আমরা পুলিশকে সিসি টিভি ফুটেজ দিয়েছি। কিন্তু এখনও ফুটেজ দেখে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগছে।

এর পর হাজীগঞ্জ বাজারে রাজলক্ষ্মী নারায়ণ জিউআখড়া পরিদর্শন করা হয়। সেখানে পূজা মন্ডপ, প্রতিমা, প্যান্ডেল সবকিছু তছনছ করে সন্ত্রাসীরা ভাংচুর ও লুটপাট করে। ঐ মন্দিরের পূজা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার পালের সাথে কথা বলে জানা যায়। প্রথমে ৩০/৪০ জনের মিছিলটি যখন ৪/৫ বার বাজার প্রদক্ষিণ করে সে সময়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী হস্তক্ষেপ করলে হয়তো পরিস্থিতি এতদূর গড়াতো না। কিন্তু পুলিশ যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি করে। গুলিতে ৪ জন হামলাকারী নিহত হয়েছে বলে পুলিশ প্রশাসন স্বীকার করেছে। যা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে।

হাজীগঞ্জে নবদূর্গা ও দশভূজাসহ আরও ৩/৪টি পূজা মন্ডপে ভাংচুর ও লুটপাট করে। দশভূজা মন্দির এলাকায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক মানিক সাহাকে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে হত্যা করে। নিহত মানিক সাহার নববিবাহিতা স্ত্রী অন্তস্বত্তা বলে জানা যায়।

এরপর বাম জোটের প্রতিনিধি দল নোয়াখালীর চৌমুহনীতে একে একে রাধামাধব মন্দির, রামঠাকুর আশ্রম, বিজয়া সর্বজনীন পূজা মন্দির, ইসকন মন্দির পরিদর্শন করেন এবং সেখানে ঐ সব মন্দিরের পুরোহিত, সেবায়েত ও স্থানীয় জনসাধারণের সাথে কথা বলে জানতে পারেন দশমীর আগের দিন ১৪ অক্টোবর পুলিশের পক্ষ থেকে পূজারীদের বলা হয় দশমীর দিন ১৫ অক্টোবর বেলা ১১টার মধ্যেই প্রতিমা বিসর্জন দিতে। কিন্তু দেশবাসী জানে সবসময়ই সানতন ধর্মাবলম্বীদের দূর্গা পূজার প্রতিমা সন্ধ্যায় বিসর্জন দেয়া হয়। নিরাপত্তাহীনতা ও ভীতিকর অবস্থার কারণে প্রশাসনের কথামতো তারা ১১টার মধ্যেই প্রতিমা বিসর্জন দেয়।
কিন্তু তারপরেও তাদের উপর হামলা, নির্যাতন, লুটপাট বন্ধ হলো না। দশমীর দিন ১৫ অক্টোবর জুম্মার নামাজের পর নারায়ে তাকবির, কোরানের অবমাননা সইবোনা ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা ২টার সময় মিছিল সহকারে হল্লা করে একে একে ১৩টি মন্দির, পূজা মন্ডপ, হিন্দুদের বাড়ীঘর, চৌমুহনী বাজারে দোকানপাটে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। বিজয়া সর্বজনীন পূজা মন্ডপের তত্ত্ববাধায়ক উৎপল সাহা জানায় প্রশাসনের কথা মতো ১১টার মধ্যে বিসর্জন দেয়ার পরও আমাদের উপর হামলা কেন? আমরা কি এদেশের নাগরিক না? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, সরকার কেন আমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলো? ঐ মন্দিরেই যতন সাহাকে হামলাকারীরা পিটিয়ে হত্যা করে।

উৎপল সাহা হলেন, ৫ বছর পর আমার শ্যালক যতন সাহা পূজায় আমার বাড়ীতে এসে ধর্মান্ধদের  হাতে খুন হলো। আমি তার ৪ বছর বয়সের শিশু পুত্রকে কি জবাব দিব। তিনি জানান এটা স্বতস্ফূর্ত কোন হামলা নয়, কারণ হামলাকারীরা গান পাউডার, লোহার পাইপে বারুদ দিয়ে বোমা বানিয়ে তা দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অগ্নিকান্ড ঘটিয়েছে। ঢাকা থেকে কোন এক গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন পরিচয়ে এসে ঐ আলামত নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, মন্দির ভাংচুর করেছে, প্রণামীর টাকা পয়সা, স্বর্ণলংকার লুট করেও সন্ত্রাসীরা ক্ষান্ত হয়নি। ওরা আমাদের বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার স্ত্রী, ৩ কন্যা, নিহত শ্যালকের স্ত্রীকে দোতলায় উঠিয়ে দেখি আগুন জ¦লছে। দরজা তালা ও বিভিন্ন জিনিস দিয়ে আটকে রাখে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা এখনো ট্রমাটাইজ হয়ে আছে। ঘুমের মধ্যেও তারা কেঁদে ওঠে। ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হয়। এখানেও পুলিশকে খবর দেয়ার দেড়-দুই ঘণ্টা পরে সন্ত্রাসীরা চলে যাওয়ার পর তারা আসে। এখানেও প্রণামীর কয়েক লক্ষ টাকা হামলাকারীরা নিয়ে যায় বলে তিনি জানিয়েছেন। আমাদের প্রতিনিধি দল নিহত যতন সাহার স্ত্রী লাকী রানী সাহা, বোন মুক্তা রানী সাহা ও শিশুপুত্র আদিত্য’র সাথে সাক্ষাত করেছেন। তাদের সান্তনা দেয়ার কোন ভাষা আমাদের ছিল না। যতন সাহার স্ত্রীও বাকরুদ্ধ, কোন কথা বলতে পারছিল না, শুধু কাঁদছিল।

এর পর  ইসকন মন্দির পরিদর্শনে গিয়ে সেখানকার পুরো মন্দির এলাকায় লন্ডভন্ড দৃশ্য দেখা যায়। সেবায়েত রসপ্রিয় দাস রতেœশ^র দেবনাথের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২টা ১৫ মিনিটে ঐ মন্দিরে হামলা করে ১০০০/১৫০০ জনের একটি জঙ্গী মিছিল। এখানে হামলাকারীদের হাতে ২ জন নিহত হয়েছে। পান্থ দাস নামের এক ভক্তকে কুপিয়ে মেরে পাশের পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়। পরদিন পুকুরে তার লাশ ভেসে উঠলে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। আরেকজন নিমাই দাস নামের একজনকে মাথায় ১০/১২টি কোপ দিয়ে তাকে মাটিতে থেতলে দেয়া হয়। যেখানে থেতলে দেয় সেখানে তার চুল ও ছোপ ছোপ রক্তের দাগ ২ দিন পরে গিয়েও আমরা দেখতে পেয়েছি। ইসকনের সেবায়েত বলেছেন পূজায় বিভিন্ন ভক্তদের দেয়া প্রণামীর টাকা, স্বর্ণলংকারসহ প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার মালামাল সন্ত্রাসীরা লুট করেছে।

সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বাম জোটের প্রতিনিধি দল সর্বশেষ কুমিল্লার নানুয়ার দিঘীর পাড়ের পূজা মন্ডপ ও চকবাজার এলাকায় চাঁদমনি রক্ষা কালি মন্দির পরিদর্শন করেন। নানুয়ার দিঘীর পাড়ের পূজা মন্ডপটি রাস্তার উপর একটি অস্থায়ী প্যান্ডেলে করা হয়। দীপন সংঘ নামে একটি সামাজিক সংগঠন বহু বছর ধরে এখানে পূজা করে আসছে। এযাবৎ কোন দিন এমন ঘটনা ঘটেনি। সেখানে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায় ১২ অক্টোবর সপ্তমী  পূজা শেষ হয় রাত ৩টার দিকে। রাত ৪টার সময় সবাই লাইট বন্ধ করে চলে যায়। সকালে পূজা মন্ডপে পুরোহিত আসার আগেই লোক জন দেখতে পায় মতলবাজ কে বা কারা পূজা মন্ডপে মূল বেদির বাইরে প্রদর্শনীর জন্য রাখা  হনুমানের কোলে কোরান শরীফ রেখে দিয়েছে। সাথে সাথে পুলিশকে খবর দেয়া হলেও তৎক্ষণাৎ পুলিশ সেখানে আসেনি। ইতিমধ্যে উগ্র ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এর ছবি তুলে ফেসবুক ইউটিউবে কোরান অবমাননার কথা প্রচার করে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিতে থাকে।

পরে কোতোয়ালী থানার ওসি এসে আলামত ‘কোরান’ উদ্ধার করে বগলে নিয়ে ওয়াকিটকিতে কথা বলতে থাকে এবং ঐ ছবি ভিডিও করতে দিয়ে সারা দেশে উন্মাদনা ছড়াতে সাহায্য করে। এরপর ২/৩টার দিকে কয়েক শত মানুষ মিছিল করে ঐ পূজা মন্ডপের প্রতিমা ভাংচুর করে পুকুরে ফেলে দেয় এবং চাঁদমনি রক্ষা কালি মন্দির সহ ৪/৫টি পূজা মন্ডপ ও প্রতিমা ভাংচুর, লুটপাট করে। চাঁদমনি রক্ষা কালি মন্দিরের পুরোহিত অমর চক্রবর্ত্তীর সাথে কথা বলে জানা যায় হামলাকারীরা পর পর ৩ বার আক্রমণ করতে আসে। প্রথম ২ বার তারা গেট ভেঙে ঢুকতে পারেনি ৩য় বারে গেট ভেঙে মন্দিরে ঢুকে তান্ডব চালায়, ভাংচুর, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে মন্দিরের সবকিছু পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। উল্লেখ্য, এই মন্দিরের সভাপতি একজন জেলা জজ হওয়ার পরও মন্দিরটি রক্ষা পায়নি। এখানেও প্রথম বার হামলার পর পুলিশকে জানালেও যথা সময়ে আসেনি।

এ সকল মন্দির, পূজা মন্ডপ, বাড়ীঘর, দোকানপাট সরেজমিন পরিদর্শন করে, পুরোহিত, সেবায়েত, স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী জনগণ, আক্রান্ত, আহত ব্যক্তিবর্গ, নিহতদের পরিবারের সাথে কথা বলে প্রতিনিধি দলের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, ১৩ তারিখ কুমিল্লার ঘটনার পূর্বাপর সকল ঘটনা এবং সর্বশেষ রংপুরের ঘটনার মাধ্যমে পরিষ্কার যে, এটা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার হীন অপচেষ্টা। আর এ ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, সরকার প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অনুষ্ঠান পালনের নিশ্চয়তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর পরও যথাসময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা করেছে যা গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায়। ফলে দূর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের দায় সরকারের এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন ভাবেই এড়াতে পারে না।

সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বাম গণতান্ত্রিক জোট মনে করে সরকারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদ এবং পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ছাড়া এ ধরনের হামলা-ভাংচুর কয়েক দিন ধরে চলতে পারে না। কারণ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। তাদের কাজই হলো যে কোন সন্ত্রাস, সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের পরিকল্পনার আগাম তথ্য সংগ্রহ করা। সে জন্যই জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন ভাতা নির্বাহ করা হয়। কিন্তু পূজাকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা সারা দেশে ঘটলো তার খবর সংগ্রহ করতে কি গোয়েন্দারা ব্যর্থ হয়েছে? সরকার সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটতে দিয়ে ঘটনার পর এখন অসাম্প্রদায়িক সেজে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছে।

বর্তমান ভোট ডাকাতির সরকার হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতা ঢাকতে এবং ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতেই সরকার একদিকে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটতে দিয়ে দেখাতে চায় দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই তাদের দমনের নামে, ভোটার বিহীন ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে এবং জায়েজ করতে চায়। অন্যদিকে ভারতেও বিজেপি সরকার বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হামলাকে কাজে লাগিয়ে ঐ দেশে হিন্দুত্ববাদ জাগিয়ে তুলে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চায়। ফলে ভারত ও বাংলাদেশের সরকারের পারস্পরিক যোগসাজশ এখানে স্পষ্ট। বাংলদেশে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা বাড়লে ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর লাভ হয়। আবার ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা বাড়লে বাংলাদেশে মুসলিম সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর লাভ হয়। এরা পরস্পর পরস্পরের সহযোগি।

সাংবাদিক বন্ধুগণ,
সরকার সবসময় তার বিভাজন নীতিতে দেশ শাসন করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভোট ব্যাক হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। সরকারের চরিত্র হলো সর্প হয়ে দংশন করো ওঝা হয়ে ঝাড় এর মতো। গত কয়েক দিনে প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরব থেকে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক তা-ব চালাতে দিয়ে এখন সরাকরি দল, অঙ্গ সংগঠন ও তাদের পোষ্য সংগঠন এবং ব্যক্তিদের মাঠে নামিয়ে অসাম্প্রদায়িক সাজার চেষ্টা করছে। দেখাতে চায় তোমাদের রক্ষাকর্তা আমরা, আগামীতে আমদেরকই ভোট দিতে হবে নইলে রক্ষা নাই। কিন্তু দেশবাসী জনগণ সরকারের এ চাতুরী ধরে ফেলেছে।

সাংবাদিক বন্ধুগণ,
এ প্রেক্ষিতে বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই দেশে গত কয়েক দিনে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য সরকারই দায়ী। ফলে এই সরকারের আর ক্ষমতায় থাকার কোন নৈতিক অধিকার নাই। ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরকারকে এখনই পদত্যাগ করা উচিত। আমাদের দাবি-
১. কুমিল্লা, হাজীগঞ্জ, চৌমুহনী, রামগঞ্জ, রামগতি, চট্টগ্রাম, বাঁশখালী, কক্সবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, খুলনা, ফেনী, নাটোর, রংপুরসহ সারা দেশে সাম্প্রদায়িক হামলাকারী ও তাদের মদদদাতাদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
২. সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির কমিটিকে ও বাড়ীঘর, দোকানপাটের মালিকদের এবং নিহত আহতদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩. মন্দির, মন্ডপে হামলার দায় সরকারের। ব্যর্থতার দায়ে অবিলম্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অপসারণ করতে হবে। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলা-উপজেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সিভিল প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অবহেলা-ব্যর্থতার অপরাধে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
৪. সংবিধানের ৩২ ধারা পুনস্থাপন করে ধর্মীয় রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।
৫. সংবিধান, রাষ্ট্রীয় আইন-বিধিবিধান, পাঠ্যপুস্তক থেকে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য, লেখাসহ সকল উপাদান বাদ দিতে হবে।
৬. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৭. ধর্মীয় বক্তব্যের নামে সাম্প্রদায়িক উস্কানী দেয়া শাস্তিমূলক অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। ফেসবুক, ইউটিউবে সাম্প্রদায়িক বয়ান নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ করতে হবে।
আমরা দেশের সকল বাম-প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তি গোষ্ঠীকে উপরোক্ত দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি।
উপরোক্ত দাবি আদায় ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সম্প্রীতি রক্ষার দাবিতে বাম গণতান্ত্রিক জোট আগামী ২১ অক্টোবর ২০২১ বৃহস্পতিবার সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিরোধ দিবস পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হচ্ছে। ঐ দিন সারা দেশে সভা-সমাবেশ-মানববন্ধন, পদযাত্রা-বিক্ষোভ এর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিরোধ দিবস পালন করা হবে। আমাদের বক্তব্য শোনার জন্য আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করি আপনারা আমাদের বক্তব্য আপনাদের প্রচার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরবেন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করবেন।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন

Login to comment..