প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বাম গণতান্ত্রিক জোট কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের পক্ষ থেকে সংগ্রামী শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
অগ্নিকাণ্ডে ভস্মিভূত সেজান জুস কারখানা পরিদর্শন এর অভিজ্ঞতা ও আমাদের দাবি তুলে ধরার জন্য আজকের এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।
সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আপনারা জানেন গত ৮ জুলাই ২০২১ বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কর্ণঘোপে সজিব গ্রুপের হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজ করখানা তথা সেজান জুস করখানায় এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। এতে সরকারি ঘোষণামতে ৫২ জন শ্রমিক নিহত ও শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছে। সংবাদপত্রের ভাষ্যমতে আরও অনেকে নিখোঁজ রয়েছে।
বাম গণতান্ত্রিক জোট কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল গত ১২ জুলাই ২০২১ সোমবার সকাল ১১টায় রূপগঞ্জের কর্ণঘোপে হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজ তথা সেজান জুস কারখানা সরজমিন পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শনকালে কারখানার বিভিন্ন তলা ঘুরে ঘুরে দেখেন। সেখানে কারখানার শ্রমিক, নিহত-আহত শ্রমিকদের স্বজন এবং স্থানীয় জনসাধারণের সাথে মতবিনিময়কালে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে তা আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরছি। কারখানার ৬ তলা ভবনটি বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করা হয়নি। ভবনের ৩৪ হাজার বর্গফুটের প্রতি ফ্লোরের গেট অগ্নিকাণ্ডের সময় তালা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। অথচ শ্রম আইনের ৬২ (৩ ও ৩ক) ধারা অনুসারে কর্মকালীন অবস্থায় কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো কক্ষ থেকে বহির্গমনের পথ তালাবদ্ধ বা আটকিয়ে রাখা যাবে না এবং বহির্গমনের পথে বাধাগ্রস্থ কিংবা পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা যাবে না।
পরিদর্শনকালে আমাদের প্রতিনিধি দল কারখানার নীচ তলায় রাখা প্যাকেজিংয়ের এল্যুমিনিয়াম ফয়েল পেপার, কেমিক্যাল, ভোজ্যতেলের ড্রামসহ দাহ্য পদার্থের গোডাউন দেখতে পায়, যা অগ্নিনির্বাপন আইনের পরিপন্থি। অগ্নিনির্বাপন বিধিমালা ২০১৪ এর ১৩ তফসিলের ৭, ৮ ও ৯ নং বিধি অনুসারে কোনো ভবনে ১ হাজার জনের বেশি মানুষ বাস করলে বা কাজ করলে কমপক্ষে ৪টি জরুরি নির্গমণ সিঁড়ি থাকতে হবে এবং জরুরি নির্গমণ সিঁড়ির সমসংখ্যক বিকল্প সিঁড়ি থাকতে হবে এবং সিঁড়িসহ সকল যাতায়াতের পথ ভালোভাবে আলোকিত থাকতে হবে। সিড়িতে টাইলস ব্যবহার করা যাবে না যেন জরুরি উঠানামা করতে গিয়ে স্লিপ করে পড়ে না যায়। কিন্তু সেজানের সিড়িতে টাইলস ছিল, শ্রম বিধিমালা ২০১৫ এর ৫৪(৮,৯,১০) নং বিধি অনুসারে কমপক্ষে অর্ধেক সংখ্যক সিঁড়ির শেষ প্রান্ত ভবনের বহির্মূখী হবে, চিলেকোঠার দরজা খোলা রাখতে হবে এবং বায়ু চলাচল নিশ্চিত করতে হবে যেন সিঁড়ি কখোনো ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে না পড়ে। বহুতল ভবনের নিচতলায় দড়ির জাল সংরক্ষণ করতে হবে যা অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হলে লাফিয়ে পড়া শ্রমিকদের ধারণ করতে ব্যবহার করতে হবে। ৫৪ (২) বিধি অনুসারে কোনো শ্রমিকের কাজের স্থান থেকে জরুরি নিগর্মণের পথের দূরত্ব ৫০ মিটার বা ১৫০ ফুটের অধিক হবে না। কিন্তু হাশেম ফুড এন্ড বেভারেজ কারখানার ৬ তলা যে ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে তার প্রতিটি ফ্লোর ৩৪ হাজার বর্গফুটের সেখানে মাত্র ২টি সিঁড়ি কারখানার ভেতর দিকে ছিল যার একটি বন্ধ ছিল অন্যটিতে কোনো বৈদ্যুতিক বাতি ছিল না, সেখানে সিঁড়ি ছিল অন্ধকার ও অপ্রশস্ত, শ্রমিকদের মোবাইলে লাইট জ্বেলে উঠানামা করতে হতো, অগ্নিকাণ্ডের সময় একটি সিঁড়ির চিলেকোঠার প্রান্ত ছিল তালাবদ্ধ। যা সম্পূর্ণ বেআইনী। শ্রম বিধিমালা ২০১৫ এর ৫৫ (১,২,৩,৫,৮) অনুসারে প্রতি ১০০০ বর্গ মিটারের ফ্লোরের জন্য প্রতি ফ্লোরে একই স্থানে ২০০ লিটার পানি ভর্তি পাত্র এবং ৪ টি বিশেষ ভাবে চিহ্নিত খালি বালতি থাকতে হবে, হোজরিল, ফায়ার এক্সটিংগুইসার থাকতে হবে। ৫০০০ লিটারের জলাধার এবং ১৮ শতাংশ শ্রমিকের অগ্নি নির্বাপনের প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। কেমিক্যাল, তেল জাতীয় দাহ্য পদার্থ থাকলে পানিতে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না ফলে সেখানে কার্বনডাইঅক্সাইড ফোম থাকা আবশ্যক। সেজান কারখানায় কোনো ফোম ছিল না। ৫৫ (১২) বিধি অনুযায়ী কোনো কারখানায় ৫০০ জনের অধিক শ্রমিক কাজ করলে সেখানে একজন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে যিনি অগ্নিনির্বাপক সরাঞ্জমাদি রক্ষণাবেক্ষণ করবেন এবং ছয় মাস পরপর শ্রমিকদের জন্য পুন:প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। হাসেম ফুডের কারখানায় উপরোক্ত বিধানগুলির কোনোটিরই বাস্তবায়ন ছিল না। সেক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট এই কারখানার লাইসেন্স নবায়ন করল কিভাবে? আর যদি নবায়ন না করে থাকে তাহলে তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক তদারক করা করা হলো না কেন?
সংবাদিক বন্ধুগণ,
আমাদের প্রতিনিধি দল যখন ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে ঘুরে ভস্মিভূত এল্যুমিনিয়াম ফয়েল পেপার, লিচির বোতল, সেমাইয়ের কার্টুন, প্লাস্টিকের বোতল, পুড়ে যাওয়া ফ্যান ইত্যাদি দেখছিলেন সেখানে ৩য় ও ৪র্থ তলায় তখনও আগুনের ধোঁয়া উড়তে এবং ৫ তলায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়। ৪র্থ তলায় একটি কালো ভষ্মিভূত স্তুপের মধ্য থেকে মেয়েদের কামিজের পোড়া কাপড়ের একটি অংশ মোড়ানো একটি হাড় তুলে একজন শ্রমিকের স্বজন চিৎকার করে বলে উঠেন এটি তার মৃত মেয়ের হাড়। তার মেয়ে ঐ ফ্লোরে কাজ করতো। এ ঘটনায় নেতৃবৃন্দ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ৫ দিন পরে গিয়েও যেখানে মানুষের হাড়গোড় পাওয়া যায়, আগুন জ্বলতে দেখা যায় তখন ২ দিন আগেই ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল কিভাবে ঘোষণা করতে পারেন সেখানে আর কোনো মৃতদেহ নাই? তাছাড়া অনেক শ্রমিকের স্বজনেরা কারখানার গেটে এসে তাদের স্বজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
পরিদর্শন শেষে আমরা এই মতে পৌঁছাই যে, সেজান জুস এর অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকের মৃত্যু এবং আহত হওয়ার ঘটনা নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি মালিক ও সরকার প্রশাসনের অবহেলা, গাফিলতিজনিত ও কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। কারণ একটি কারখানা করতে হলে (1) TIN Certificate of
Sponsors and Company, (2) Company Registration at RJSC, (3) Trade License, (4)
Bank Account, (5) Vat Registration Certificate, (6) Membership from respective
Association, (07) Board of Investment permission, (08) Import Registration
Certificate & Export Registration Certificate, (9) Fire License, (10)
Chemical/ explosive license, (11) Factory Layout Approval & License, (12)
Environmental Clearance Certificate, (13) Certificate from Export Promotion
Bureau, (14) Electrical Connection document, (15) Gas connection document, (16)
Bangladesh Energy Regulatory Commission permission, (17) Custom Bond License, (18)
Building authority Permission, (19) Compliances issues (Safety, Security,
Standard), (20) Bonded Warehouse License, (21) Certificate of registration of
factories & establishment, (22) Registration of Foreign Investment/Joint
Venture/ Foreign Loan, (23) Registration/Permission for appointing foreign
people. ইত্যাদি ২৩ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অনুমতি লাগে অথচ সেজানের মালিক সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে, শ্রম আইন-শিল্প আইন লংঘন করে দিব্যি কারখানা চালিয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। ফলে আমরা মনে করি এই ঘটনার দায় কোনো মতেই মালিক এবং সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও সরকার এড়াতে পারে না। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুসারে ১৪ বছর বা তার কম বয়সের শিশু নিয়োগ নিষিদ্ধ কিন্তু ঐ কারখানায় ১২/১৪ বছরের শতাধিক শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হতো বলে কারখানার শ্রমিক ও স্থানীয়রা বলেছেন। সেজানের মালিক ব্যাংক থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ঐ ঋণের টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে মালিক পক্ষ থেকেই আগুন লাগানো হয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা দরকার।
সাংবাদিক বন্ধুগণ,
সরাকরি তদারককারী সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালন না করায় এবং মালিকের মুনাফালোভ ও অবহেলা অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণে এবং ভবন ধসে (১) ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন (২) ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীনে ১১২ জন (৩) ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ট্যাম্পাকোয় ৩৯ জন (৪) ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ৭১ জন (৫) নারায়ণগঞ্জের তল্লায় ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ৩৪ জন (৬) এ বছরের ২৭ জুন মগবাজারে ১১ জন মৃত্যুবরণ করেছে। (৭) ২০১৩ সালে রানা প্লাজায় ভবন ধসে ১১৭৫ জন মৃত্যুবরণ করেছে। এ সকল ঘটনায় মালিক ও সরকার প্রশাসনের কারো বিচার ও শাস্তি না হওয়ায়ই একের পর এক এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে চলেছে। এ পর্যন্ত ৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৯টি রিট হয়েছে। কোনোটিরই বিচার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি।
সাংবাদিক বন্ধুগণ,
একের পর এক মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলছে। এটা বন্ধ করা দরকার। এ জন্য আমাদের দাবি (১) সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের পরিবার প্রতি আইএলও কনভেনশন ১২১ অনুযায়ী আজীবন আয়ের সমান অর্থাৎ ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান, আহতদের উন্নত চিকিৎসা-পুনর্বাসন-ক্ষতিপূরণ এবং নিহত-আহত-নিখোঁজ শ্রমিকের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে হবে (২) নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে অগ্নিকাণ্ডের কারণ, অনিয়মসহ প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে হবে (৩) মালিক হাসেমসহ দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও গাফিলতির জন্য দায়ী কল কারখানা পরিদর্শক, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনা, বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে (৪) ঈদের পূর্বেই শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-বোনাস-ওভারটাইম পরিশোধ করতে হবে।
উক্ত দাবি অবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্য আমরা সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। একই সাথে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য বাম জোটের পক্ষ থেকে ঘোষণা করছি। ঈদের আগেই আমরা বাম জোটের পক্ষ থেকে কারখানা গেটে শ্রমিক জনসমাবেশ ও ঈদের পর শ্রম মন্ত্রণালয় ঘেরাও করা হবে। সুনির্দিষ্ট তারিখ ও সময় পরে জানানো হবে।
বাম জোট কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের সমন্বয়ক ও বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ এর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন বাম জোটের কেন্দ্রীয় নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সাইফুল হক, সিপিবি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য কমরেড আব্দুল্লাহ আল কাফি রতন, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক কমরেড মোশাররফ হোসেন নান্নু, বাসদ (মার্কসবাদী)’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরামের সদস্য কমরেড মানস নন্দী, গণসংহতি আন্দোলনের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য কমরেড বাচ্চু ভুইয়া, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির কমরেড শহীদুল ইসলাম সবুজ, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সভাপতি কমরেড হামিদুল হক ও বাসদ এর কেন্দ্রীয় পাঠচক্রের সদস্য কমরেড আহসান হাবিব বুলবুল। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের সাথে আরও যুক্ত হন নারায়ণগঞ্জ জেলা বাম জোটের সমন্বয়ক ও বাসদ জেলা সমন্বয়ক কমরেড নিখিল দাস, সিপিবি নেতা মন্টু ঘোষ, শিবনাথ চক্রবর্ত্তী, বিমল কান্তি দাস, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির আবু হাসান টিপু, রাশিদা বেগম, গণসংহতি আন্দোলনের তরিকুল সুজন, জেলা শ্রমিক ফ্রন্ট নেতা সেলিম মাহমুদ ও রূপগঞ্জের স্থানীয় বাসদ নেতা মোঃ সোহেল।