ঘোষণা ও কর্মসূচি (৭, ৮ ও ৯ মার্চ ১৯৯৯-এ অনুষ্ঠিত সপ্তম পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত এবং ১১, ১২ ও ১৩ অক্টোবর ২০১২ ঢাকায় অনুষ্ঠিত দশম কংগ্রেস পর্যন্ত সংশোধিত)

Posted: 01 জানুয়ারী, 2015

সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধন করুন বাংলাদেশের ইতিহাস শ্রমে, সৃজনে, বিদ্রোহে ও স্বপ্নে বর্ণিল এক ইতিহাস। সুপ্রাচীনকাল থেকে এদেশের জনগণ ও মেহনতি মানুষ শ্রমে ও মেধায়, কর্মে ও সাধনায় যে সভ্যতা নির্মাণ করেছিল, তার একটি নিজস্ব সমৃদ্ধি ছিল। শস্য-শ্যামলা বলে এ দেশের খ্যাতি ছিল। বাংলার কারুশিল্প পণ্যের খ্যাতি ও বাণিজ্য বিস্তৃত ছিল নিকটপ্রাচ্য এমনকি ইউরোপ পর্যন্ত। লোক সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের পাশাপাশি বাঙালি মনীষীরা সৃষ্টি করেছিলেন শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতের ঐশ্বর্যময় ভান্ডার। অথচ এই সমৃদ্ধির নির্মাতা মেহনতি মানুষ ও জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী শোষণ-বঞ্চনায় নিষ্পেষিত হয়েছে। এদেশের সকল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও রাজনৈতিক-সামাজিক সংগ্রামের ধারায় গড়ে উঠেছে এক উজ্জ্বল মানবিক, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ। প্রায় আড়াই শত বছর আগে সমগ্র উপমহাদেশ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির কবলে পড়ে। ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থে আরোপিত ধারা আমাদের দেশসহ সমগ্র উপমহাদেশের স্বাভাবিক অগ্রগতি ও স্বাধীন বিকাশের পথ রুদ্ধ করে। জনগণের উপর তীব্র শোষণ ও দমননীতি চালিয়ে এদেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যাওয়া হয়। ব্রিটিশ শাসকরা মানবিক মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি পায়ের তলায় পিষ্ট করে আমাদের দেশের উপর ঔপনিবেশিক শোষণের স্টিম রোলার চালায়। একদিকে তারা এ অঞ্চলের প্রাচীন এশীয় সমাজের ধ্বংস সাধন করে, অপরদিকে পাশ্চাত্য সমাজের ঔপনিবেশিক পশ্চাৎভূমি হিসেবে তার বৈষয়িক ভিত্তির প্রতিষ্ঠা করে। এদেশের মানুষ প্রথম থেকেই জুলুমবাজ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম গড়ে তোলে। সাঁওতাল, গারো, হাজং প্রভৃতি আদিবাসী বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ, ওয়াহাবি-ফরায়েজি প্রভৃতি ধর্মীয় ঝান্ডায় প্রবল রাজনৈতিক সশস্ত্র সংগ্রাম, ঊনিশ শতকে শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর নবজাগরণ, সিপাহী বিদ্রোহ, জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলন, অগ্নিযুগের সশস্ত্র জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলন, প্রজা আন্দোলন, সংগঠিত শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-যুব ও নারী আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে তোলে। দীর্ঘকালব্যাপী উপমহাদেশের জনগণের তীব্র সংগ্রাম, বিশ্ব সমাজতন্ত্রের উদ্ভব ও উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবাধীন কৃষক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর জঙ্গি আন্দোলন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নসহ মিত্রশক্তির হাতে নাজী জার্মানি ও জাপ সমরবাদের পরাজয়ের বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ভারত উপমহাদেশে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। অবশ্য ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িকতা ও বিভেদের রাজনীতির পরিণতিতে উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান এ দু’টি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাকিস্তানি আমলেও দেশবাসীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় নি। বাঙালি জাতি পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদনির্ভর একচেটিয়া ধনিক, বৃহৎ ভূস্বামী, সামরিক-বেসামরিক আমলা ও সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রভাবিত শাসকদের ঔপনিবেশিক ধরনের শাসন-শোষণের শিকার হয়। দেশের পশ্চাৎপদতা অব্যাহত থাকে। ব্রিটিশ শাসন অবসানের পরেই পাকিস্তানে দৃঢ় হয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব। বাংলাদেশের মেহনতি মানুষের সৃষ্ট সম্পদ স্থানান্তরিত হতে থাকে পাকিস্তান ও সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহে। পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির জাতীয় বিকাশের আকাঙ্ক্ষাকে স্বৈরাচারী পন্থায় দমন ও জাতিগত শোষণ-পীড়নের নীতি অনুসরণ করে। তারা সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরাচার ও কমিউনিস্ট বিরোধিতাকে রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত করে। পাকিস্তানি শাসকদের এই জাতিগত শোষণ, দমন-পীড়ন ও প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে দেশবাসী মাতৃভাষার অধিকার, গণতন্ত্র ও জাতীয় বিকাশের দাবিতে তীব্র সংগ্রাম গড়ে তোলে। তেভাগা আন্দোলন, টংক, নানকার প্রভৃতি প্রথার বিরুদ্ধে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ, নাচোলে আদিবাসীদের বিদ্রোহ, ’৪৮-এর ভাষা সংগ্রাম ও মুক্তবুদ্ধির সংগ্রাম, ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা সংগ্রাম, পরবর্তীতে ১১ দফা আন্দোলন ও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, শ্রমিক-কৃষক-বুদ্ধিজীবী-নারী-ছাত্র-জনতার বিভিন্ন গণসংগ্রাম, ’৭০ ও ’৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন, বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সুরক্ষার সংগ্রাম, গণতন্ত্র, স্বাধিকার ও সাধারণ মানুষের স্বার্থে প্রগতিশীল বিকাশের দাবিতে আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা অসংখ্য গণসংগ্রাম পাকিস্তানের ভিতকে নাড়িয়ে দেয়। অবশেষে ১৯৭১ সালে লাখো শহীদের রক্ত ও কোটি মানুষের আত্মত্যাগের মহান এক বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও চীনের তদানীন্তন নেতৃত্বের মদদপুষ্ট পাকিস্তানি শাসকদের নাগপাশ ছিন্ন করে দেশবাসী জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করে এবং পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল দ্বি-জাতি তত্ত্বকে পরাভূত করে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। এই মহান মুক্তিযুদ্ধে মুষ্টিমেয় দালাল, রাজাকার ও আল-বদর ব্যতীত শ্রমিক-কৃষক-ক্ষেতমজুর-ছাত্র-যুব-বুদ্ধিজীবী-সাংস্কৃতিক কর্মী, মধ্যবিত্ত, নারী সমাজ, বাঙালি সৈনিক ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যসহ দেশবাসী পালন করে এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। স্বাধীনতার জন্য দেশবাসীর মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে এগিয়ে আসে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন, গণতান্ত্রিক ভারতসহ সারা বিশ্বের শান্তি, গণতন্ত্র, প্রগতি ও সমাজতন্ত্রের শক্তিগুলো। বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মুক্তি সংগ্রামের ধারার সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে ওঠে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়ার অবস্থানকে দুর্বল করে। দেশবাসীর অন্তরে সৃষ্টি হয় নতুন প্রত্যাশা। স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিকাশ, উন্নয়ন ও জনগণের ভাগ্য বদলের এক নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ আমাদের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার কতগুলো প্রগতিশীল নীতি ঘোষণা করে এবং কতক পদক্ষেপও গ্রহণ করে। এই ধারায় ১৯৭২ সালের সংবিধানে গৃহীত হয় রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। শিল্প জাতীয়করণ ও রাষ্ট্রীয় খাতের অগ্রাধিকারের ফলে স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও ঘুষ, দুর্নীতি ও লুটপাট, রাষ্ট্রীয় খাতের অপব্যবহার প্রভৃতি এক নব্য ধনিক গোষ্ঠীর অভ্যুদয়ের পথ প্রশস্ত করে দেয়। ক্রমে শাসক দলে এই গোষ্ঠীর প্রভাব বৃদ্ধি পায়। দলের ভেতরের বাধার কারণে জাতীয় অগ্রগতি ও বিকাশের অন্যতম মূল পূর্বশর্ত মৌলিক ভূমি সংস্কার না করায়, গ্রামাঞ্চলে সাবেকি উৎপাদন কাঠামো অব্যাহত থেকে যায়। জাতীয় স্বার্থে ও জনগণের স্বার্থে ঔপনিবেশিক আমলের আমলাতন্ত্র ভেঙে দিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে না পারায় এবং পুরনো প্রশাসন অব্যাহত রাখায় গৃহীত নীতিগুলো বাস্তবায়নে সমস্যা সৃষ্টি হয়। এইসব কারণে শাসক দলের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা আরো বেড়ে যায়। দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয় এবং সরকারের গৃহীত প্রগতিশীল পদক্ষেপগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হয় না। সামগ্রিক জটিলতায় বিশেষত অর্থনৈতিক কারণে সাম্রাজ্যবাদের কতক শর্ত সরকার ক্রমে মানতে বাধ্য হয়। জনজীবনে সংকট ক্রমেই তীব্র হতে থাকে। দীর্ঘ দিনের সংগ্রামের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সাধারণ জনগণ ও মধ্যস্তরের মানুষের যে আস্থা অর্জন করেছিল, তাতে চিড় ধরে। আওয়ামী লীগের সামাজিক ভিত্তি ক্রমে দুর্বল হতে থাকে। ১৯৭৫’র জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার সংসদে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রথমে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসন প্রবর্তন করে এবং পরে একদলীয় ব্যবস্থা চালু করে। এই সাংবিধানিক পরিবর্তন সে সময় সরকারকে আরো জনবিচ্ছিন্ন করে। স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে স্বাধীন জাতীয় বিকাশের যে সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছিল, তার বিপরীতে সাম্রাজ্যবাদনির্ভর ধনবাদী ধারা বহাল করার জন্য সাম্রাজ্যবাদ-পেট্রোডলার এবং শাসক দলের ভেতরে ও বাইরে তাদের সহযোগীরা প্রথম থেকেই চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট জনগণের সৃজনশীল ক্ষমতা ও উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক বিকাশ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। কমিউনিস্ট পার্টি সরকারের প্রগতিশীল পদক্ষেপসমূহ এবং রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি বাস্তবায়নে দৃঢ় ও নীতিনিষ্ঠ ভূমিকা রাখলেও, সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেনি। অন্যান্য প্রগতিশীল শক্তিও এক্ষেত্রে যথাযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি, বরং কোনো কোনো মহলের উগ্র ও ভ্রান্ত নীতি-কৌশলের ফলে প্রতিক্রিয়াশীল মহলই লাভবান হয়। এই পটভূমিতে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে জাতীয়-আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার চক্রান্তে, সামরিক বাহিনীর এক অংশের অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রতিক্রিয়ার ধারা নিরঙ্কুশ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পঁচাত্তর-পরবর্তী শাসকদের অভ্যন্তরীণ নীতির মূল কথা হলো : সাম্রাজ্যবাদনির্ভর লুটেরা ধনবাদের ধারা অনুসরণ, সাম্রাজ্যবাদী লগ্নী পুঁজিকে অবাধ সুযোগ প্রদান এবং সাম্রাজ্যবাদনির্ভর আমলা মুৎসুদ্দী পুঁজির প্রসার ও তাদের স্বার্থে বিরাষ্ট্রীয়করণ, গ্রামাঞ্চলে নব্য কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী সৃষ্টি, জনগণের অধিকার খর্ব ও হরণ করা, স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে অর্জিত সুফল নস্যাৎ করা, পাকিস্তানি আমলের সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শ ও তাদের অনুসারীদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এদের অনুসৃত বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সার কথা হলো : নিজেদের স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদ মূলত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, প্রতিক্রিয়াশীল মহল ও বৃহৎ শক্তির নিকট নতজানু থাকা ও তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত সাহায্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা, স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীল পেট্রোডলারসহ আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করা। পঁচাত্তর ও তার পরবর্তী ঘটনাসমূহ হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্র, সামরিক শাসন, একনায়কত্ব ও স্বৈরশাসনের এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ধারার সূচনা করে। এই স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের বহুমাত্রিক সংগ্রাম মাঝে মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিকাশের ক্ষেত্রে প্রভূত সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও, বুর্জোয়া রাজনীতির দেউলিয়াপনার কারণে অর্জিত সাফল্য রক্ষা করা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের ক্ষেত্রে কিছু কিছু উপাদান যুক্ত হলেও একথা বলা চলে যে, দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি পরিচালিত হচ্ছে মূলত দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থের অনুকূলে। ফলে একটি গৌরবজনক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ যে গণতান্ত্রিক মুক্ত স্বদেশের স্বপ্ন দেখেছিল তা ক্রমেই ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে থাকে। বিশ্ব পরিস্থিতি সাম্প্রতিককালে বিশ্ব পরিস্থিতিতে ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। সত্তর দশকের শেষ দিকে বিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিপ্লবের এই নব অধ্যায় সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় এক গভীর পরিবর্তনের সূচনা করেছে। এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে : অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তিতে সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার কাঠামোগত পুনর্গঠন এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় মাইক্রো ইলেকট্রনিক্স, কম্পিউটার, রোবট, স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, জৈবপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, তথ্য-প্রযুক্তি, অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, মহাকাশ প্রযুক্তি, সমুদ্র বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান ও এনার্জি টেকনোলজিসহ বৈচিত্র্যময় প্রযুক্তির প্রয়োগ। একই সাথে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দক্ষ ও শিক্ষিত শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি, সার্ভিস সেক্টরের বিপুল বিকাশ এবং উৎপাদনে জ্ঞান, গবেষণা, মানসিক বা মেধাশ্রমের বর্ধিত ভূমিকা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে উৎপাদিকা শক্তির এক অভূতপূর্ব বিকাশ প্রক্রিয়ায় মানব সভ্যতা এসে দাঁড়িয়েছে এক নতুন সম্ভাবনাময় যুগের দ্বারপ্রান্তে। অপরদিকে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে মানব কল্যাণে ব্যবহার না করে সাম্রাজ্যবাদ একে পারমাণবিক, রাসায়নিক ও জীবাণু যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে কাজে লাগাচ্ছে এবং পারমাণবিক শক্তিধর দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই নিত্য নতুন বিশ্ব বিধ্বংসী আধুনিক অস্ত্র নির্মাণ, মানব জাতিকে নিশ্চিহ্ন হওয়ার এক ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। মুনাফা ও আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কোনো কোনো ক্ষেত্রে গবেষণা ও প্রয়োগ জলবায়ু ও প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট, মানুষ ও জীবজগতের বৈচিত্র্যকে বিকৃত ও বিপন্ন করে গোটা সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আধুনিক পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ সাম্প্রতিককালের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিপ্লবকে কাজে লাগিয়ে সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বহুজাতিক কর্পোরেশন, বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিওসমূহের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সীমান্ত ছাড়িয়ে জাতীয় সার্বভৌমত্বকে তুচ্ছ করে বৈশ্বিক আধিপত্য আরো শক্তিশালী করছে। বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ, নিজ স্বার্থে আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগের ব্যাপক দক্ষ ও কৌশলী ব্যবহার, সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতির সাথে সাথে সকল দেশের সংশ্লেষণ, অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির উপর বর্ধিত চাপ, বৈষম্য ও শোষণের মাধ্যমে আজকের পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পরিবর্তন, সমাজতন্ত্রের অভিঘাত, পুঁজিবাদী দেশগুলোর অভ্যন্তরে শ্রেণী সংগ্রাম ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পুঁজিবাদী দেশসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা, দেশের ও বিশ্বের জনমতের ক্রমবর্ধমান চাপ ও উন্নয়নের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর বহুমুখী প্রচেষ্টা প্রভৃতি কারণে পুঁজিবাদ এখন আগের মতো সকল সনাতন বৈশিষ্ট্য নিয়ে আর টিকে থাকতে পারছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নমনীয়তা প্রদর্শনে বাধ্য হলেও, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের শোষণ, অমানবিকতা ও নির্যাতনের চরিত্র নতুন নতুন রূপ ও পন্থায় অব্যাহত রয়েছে। এমন কি সুযোগ পেলেই জনগণের এযাবৎকালের অর্জিত সাফল্যগুলোকে বাতিল করে আরো উগ্র মূর্তি ধারণ করে বেপরোয়া হচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্রমাগতভাবেই উৎপাদনের সামাজিক চরিত্রের সঙ্গে সম্পদের ব্যক্তিগত ভোগ-দখলের মৌলিক দ্বন্দ্ব এবং বিচ্ছিন্নতা আরো উৎকটভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী দেখা যাচ্ছে পুঁজি ক্রমেই সনাতন পণ্য উৎপাদনভিত্তিক ক্ষেত্র থেকে সার্ভিস সেক্টর এবং শেয়ার মার্কেট, ফটকাবাজারির মতো অনুৎপাদনশীল ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান মাত্রায় বিনিয়োজিত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী ফিন্যান্স পুঁজি তাৎক্ষণিকভাবে এক দেশ থেকে আরেক দেশে সঞ্চালিত হওয়ার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। এর ফলে পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ নমনীয়তা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি আবার পুঁজি বাজারে ফটকাবাজি, গভীর অনিশ্চয়তা, সহসা অতি দ্রুত বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টির মতো আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বের পুনঃউপনিবেশিকীকরণ প্রক্রিয়ায় বাজার ভাগাভাগি, নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বজায় রাখার প্রতিযোগিতায় আমেরিকা, ইউরোপ, জার্মানি, জাপানসহ পুঁজিবাদী বিশ্বের বিভিন্ন কেন্দ্রের মধ্যে বিরোধ, উৎপাদন ও বাজারের বৈশ্বিক সামাজিক রূপ এবং এগুলোর ওপরে মুষ্টিমেয় সাম্রাজ্যবাদী শোষণের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব স্থাপনের প্রয়াসের দ্বন্দ্ব ক্রমেই গভীর হচ্ছে। পুঁজিবাদী দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি, বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যাপক ফটকাবাজারি, কালোবাজারি, চোরাচালানি, অর্থনৈতিক মন্দা ও জটিল সংকটের আবর্ত, জনগণের বৃহৎ অংশের দুঃস্থতা, মাফিয়া ও সন্ত্রাসী শক্তির দাপট, ভোগবাদ, মুনাফা সর্বস্বতা, নৈতিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের সংকট, জনজীবনে অস্থিরতা ও হতাশা, পারিবারিক ও সমাজ জীবনের সংকট, প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়া প্রভৃতির মধ্য দিয়ে সার্বিক সংকট ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ও পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তন বিশ্বের ভারসাম্যের ক্ষেত্রে এক মৌলিক পরিবর্তন এনেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল, ব্যাপক জনগণের শোষণমুক্তি, দেশ ও জনগণের জীবনে বিস্ময়কর উন্নয়ন, নারীমুক্তি, বেকারত্ব, দারিদ্র, অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি, সারা বিশ্বে শান্তি, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, জাতীয় মুক্তি ও মানবতাবাদের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অবদান এবং তার অভিঘাতে বিশ্বব্যাপী সূচিত বিবিধ পরিবর্তন কেউ আজ আর উপেক্ষা করতে পারে না। বৈজ্ঞানিক ধারা হিসেবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সৃজনশীল বিকাশ ও প্রয়োগে ত্রুটি, শ্রমিক-কৃষক জনগণের হাতে সকল ক্ষমতার পরিবর্তে বাস্তবে পার্টি ও কিছু নেতা-আমলার হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়ার প্রবণতা, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার স্থলে অতিকেন্দ্রিকতা, ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা, বিচ্ছিন্নতা, সর্ব পর্যায়ে প্রকৃত গণতন্ত্র ও জনগণের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও রাষ্ট্রের বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে রাষ্ট্রযন্ত্রের স্ফীতি, রাষ্ট্র, পার্টি ও শ্রেণীকে এক করে দেখার প্রবণতা, বিশ্ব পরিসরে ব্যাপক পরিবর্তন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মৌলিক অগ্রগতি এবং মানব সমাজ ও মনোজগতে তার প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে বিরাজমান মডেলের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধনে ব্যর্থতা ও বিলম্ব, বিশ্বব্যাপী ধনতন্ত্রের পরিবেষ্টনীতে সমাজতন্ত্রের পূর্ণ ও অবাধ বিকাশের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়নের অভাব, বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ষড়যন্ত্র ও প্রচন্ড চাপ প্রভৃতি নানাবিধ কারণে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে বিপর্যয়ের ফলে বিশ্ব আজ এক নতুন সংকটে নিপতিত হয়েছে। বিশ্বের পরিবর্তিত ভারসাম্যের সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এককেন্দ্রিক বিশ্বের নামে গোটা বিশ্বকে তার কব্জায় নেওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র ও তার অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ব্যাপারে প্রকাশ্য ও গোপন হস্তক্ষেপ, সামরিক অভিযান, নগ্ন হামলা, পুঁজি বিনিয়োগ, অসম বাণিজ্য, মুদ্রার অসম বিনিময় হার, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাসমূহের চাপ, ঋণ ও সাহায্যের শর্তাবলী, নানা ধরণের অসম অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চুক্তি, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর তথাকথিত উন্নয়ন কৌশল চাপিয়ে দেয়া, শক্তিশালী গণমাধ্যমগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন বিশ্ব সংস্থাগুলোকে নানা কৌশলে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার প্রভৃতি পন্থায় সাম্রাজ্যবাদ তার আধিপত্য ও শোষণ আরো জোরদার ও নিরঙ্কুশ করতে সচেষ্ট রয়েছে। এছাড়াও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ জাতিসংঘকে তার নিজ স্বার্থ হাসিলের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে এবং কখনো কখনো জাতিসংঘের নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে একতরফাভাবে নানা আগ্রাসী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সীমিত সার্বভৌমত্ব, এক তরফা ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার, নিবৃত্তমূলক আঘাতের অধিকার ইত্যাদি মতবাদ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, গণমাধ্যম, কম্পিউটার প্রভৃতি বিশ্বকে ছোট করে ফেলছে। বিশ্ব জোড়া উন্নয়ন ও বিকাশ, দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা এবং নতুন বিশ্ব সভ্যতা গড়ে তোলার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ধনবাদ-সাম্রাজ্যবাদ অমানবিক শোষণ ও নিপীড়ন, ভোগবাদ, মুনাফা ও আধিপত্যের যুপকাষ্ঠে বিশ্ব সভ্যতাকে বলি দেয়ার প্রচেষ্টার কারণে, মানব সভ্যতার সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ, সংঘর্ষ, উত্তেজনা, গৃহযুদ্ধ, দাঙ্গা, ধর্মান্ধতা, জাতিগত বিদ্বেষ, মৌলবাদের উত্থান, সামরিক শক্তি ও মারণাস্ত্রের বিপুল গুণগত বৃদ্ধি ও বিস্তার মানব জাতিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সেসব দেশকে সামগ্রিকভাবে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এসব দেশের জনগণ পুঁজিবাদ সৃষ্ট সংকটের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সংগ্রাম গড়ে তুলছে। অনেক দেশেই কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্র ও প্রগতির পক্ষের শক্তিগুলো অভিজ্ঞতার আলোকে পুনর্গঠিত হয়ে গণআন্দোলন ও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাচ্ছে অথবা রাষ্ট্র ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। বর্ধিত মার্কিন আগ্রাসন, চাপ, অবরোধ ও সমাজতন্ত্রবিরোধী ব্যাপক প্রচারণা সত্ত্বেও চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কিউবা নানা কৌশলে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করে সমাজতন্ত্র ও প্রগতির ঝান্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে অগ্রসর হচ্ছে। তবে চীনের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি চীনে নানামুখী অভ্যন্তরীণ বৈষম্যও আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলন নানা সংকট ও চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করছে এবং অন্যান্য বামপন্থী-প্রগতিশীল শক্তির সাথে ঐক্য ও সমঝোতা গড়ে তুলছে। বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় সরকারসমূহে বাম ও র্যািডিক্যাল শক্তিসমূহ সাফল্য অর্জন করছে। দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শোষণ, বিদ্যমান নয়া ঔপনিবেশিক শোষণ, প্রতিকূল আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক, ঋণ, সুদ ও সাহায্যের ‘বোমা’, দাতাদের আরোপিত বিকৃত উন্নয়ন ধারা, গণতান্ত্রিক বিকাশের পরিপন্থী অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থাপনা, মানব সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহারে ব্যর্থতা, দারিদ্র্য, বুভুক্ষা, নিরক্ষরতা, পুষ্টিহীনতা প্রভৃতি কারণে উন্নয়নশীল দেশসমূহ এখনো অনুন্নয়নের গুরুভার বহন করে বিশ্ব পরিমন্ডলে অবস্থান করছে। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থার আওতাধীন থাকায়, পুঁজিবাদের অসম বিকাশের শিকার হচ্ছে এবং এসব দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শোষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর এসব দেশের দরকষাকষির ক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে। এসব দেশের জনগণ ও বিভিন্ন সরকার সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গণতন্ত্রায়ন, বৈষম্যমুক্ত নয়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, বহুমুখী অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য নানাভাবে প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে ‘ন্যাটোর’ সম্প্রসারণের উদ্যোগও মসৃণভাবে এগুচ্ছে না। রাশিয়া চীনসহ কয়েকটি দেশ মিলে ইতোমধ্যেই একত্রিত হয়ে একটি অক্ষশক্তি ‘সাংহাই কো-অপারেশন’ গড়ে তুলেছে। বিশ্বজোড়া জটিল, পরস্পর সম্পর্কিত ও পরস্পরবিরোধী সুবিশাল বহুমাত্রিক পরিবর্তনের মুখে আজ প্রগতিশীল মানবতাবাদী শক্তিসমূহ নানা পন্থায় দেশে দেশে ফর্মাল, ইনফর্মাল আন্দোলন গড়ে তুলেছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের মাত্র পনের বছরের মধ্যে বিশ্বের সর্বত্র বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকায় বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। ধরিত্রী, পরিবেশ ও প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য, আর্থ-সামাজিক ব্যবধান বিলোপের জন্য, নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসানের দাবিতে, বিশ্বশান্তি, মানবিকতা ও বিশ্বের সার্বিক গণতন্ত্রায়নের লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান গণচেতনা ও নানা ধরনের গণআন্দোলনে ব্যাপক শক্তি-সমাবেশ ক্রমাগত সাম্রাজ্যবাদ বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে কোণঠাসা করছে। বিশ্ব জনমতের বিপরীতে একটি ক্ষুদ্র মুনাফাসর্বস্ব গোষ্ঠীর স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী অবস্থান আজ সকলের সামনে সুস্পষ্ট রূপে প্রতিভাত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ এবং মনোজগতকে যতই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করুক না কেন, বিশ্বজুড়ে তার বিরুদ্ধে কোনো না কোনো ভাবে লড়ে যাচ্ছে বিশ্বের মানুষ। আমরা যে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত, সে অঞ্চলের দেশসমূহ ও জনগণ অনুন্নয়ন, দারিদ্র, বেকারত্ব, পুষ্টিহীনতা, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও চাপ প্রভৃতি সাধারণ সমস্যার সম্মুখীন। এই দেশগুলোর মধ্যে অতীতের জের হিসেবে অমীমাংসিত সমস্যা, অসম বিকাশ, আধিপত্য বিস্তার এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ ও উসকানি দেয়ার প্রবণতা, সমরসজ্জা, যুদ্ধ ও সংঘাতের ফলে উন্নয়ন প্রচেষ্টা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এই অঞ্চলের দেশগুলোর সাধারণ জাতীয় বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য এবং সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয় আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করার জন্য সমমর্যাদা এবং একে অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার ভিত্তিতে বহুমুখী আঞ্চলিক সহযোগিতা অপরিহার্য। নানা উসকানি ও চক্রান্ত মোকাবেলা করে এবং নেতিবাচক মনোভাব পরিহার করে ‘সার্ক’ সংস্থাকে তাই আজকের বিশ্বের উপযোগী করে বহুমাত্রিক পারস্পরিক সহযোগিতার সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বর্তমান সংকট ও সমস্যা সাম্রাজ্যবাদনির্ভর ধনবাদী ধারায় বিকাশের ফলে এ দেশে উৎপাদনমুখী পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রকৃত বিকাশ না ঘটে, প্রধান ধারা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মুৎসুদ্দী পরগাছা মধ্যস্বত্বভোগী পুঁজি। এই মুৎসুদ্দী শ্রেণী রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও অন্যান্য সরকারি নীতিমালার সুযোগে স্ফীত হয়ে উঠছে। সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীল শাসক চক্রের ক্ষমতার আনুকূল্যে সামরিক-বেসামরিক আমলা পুঁজির অভিন্ন গাঁটছড়া বাঁধার মধ্য দিয়ে এরা শক্তিধর হয়ে উঠছে। এদের গড়ে তোলা রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে অবাধ লুটপাট, উৎপাদনে নৈরাজ্য এবং বিদেশে সম্পদ পাচারকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। কৃষি, শিল্পসহ অর্থনীতির সকল খাতের বিকাশ ও উৎপাদনমুখী কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ সকল কারণে সমগ্র জাতি ও জনগণের সাথে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের সহযোগী মুৎসুদ্দি আমলা পুঁজি এবং তাদের স্বার্থরক্ষাকারী শাসকদের মৌলিক বিরোধ ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠছে। বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ উপযুক্ত অর্থনৈতিক বিকাশের অভাবে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ছাঁটাই, চাকুরিচ্যুতি প্রভৃতি সমস্যায় জর্জরিত। শ্রমিক-কর্মচারীরা ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, ন্যায্য মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ক্ষেতমজুররা সারা বছর কাজ পায় না, ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত, চাষাবাদ ও ভিটার জমি পর্যন্ত নেই। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে অধিকার আর ইনসাফ থেকে বঞ্চিত এই গ্রামীণ সর্বহারা শ্রেণীর জীবনে স্থায়ী হয়ে রয়েছে নীরব দুর্ভিক্ষ। কৃষি কাজে ব্যয় বৃদ্ধি, কৃষি ঋণের অপর্যাপ্ততা ও সুদের উচ্চ হার, দুর্নীতি, ঘাপলাবাজি, মহাজনী শোষণ, অন্য দিকে ক্রমাগতভাবে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকদের মেরুদন্ড ভেঙে যাচ্ছে। মধ্যস্তরের জনগণ, চিকিৎসক-প্রকৌশলী-আইনজীবী-কৃষিবিদ-বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের সৃজনশীল বিকাশ, স্বাভাবিক জীবন যাপনের পথ রুদ্ধ হয়ে আসছে। বেকারত্বের অভিশাপ, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার মুখে হতাশাগ্রস্ত যুবককে ঠেলে দেয়া হচ্ছে নৈতিকতাহীনতা, সন্ত্রাস, মাদকাসক্তি ও উচ্ছৃঙ্খলতার দিকে। শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য, বৈষম্য- ছাত্র-শিক্ষকের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আগামী দিনের নাগরিক শিশু-কিশোররা সুখী, সুস্থ ও সুন্দর শৈশব থেকে বঞ্চিত। নারী সমাজ নানা বৈষম্য-নির্যাতন ও পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়নের শিকার। শিল্প বিকাশে উৎসাহী উৎপাদনমুখী ধনিকরা সাম্রাজ্যবাদ ও লুটেরা ধনিকদের দৌরাত্মে দিশাহারা। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা সাম্প্রদায়িকতা ও নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার। বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায় নানা হয়রানি, বঞ্চনা ও নিপীড়নের ফলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। জাতিগত সংখ্যালঘুরা নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ রক্ষা ও বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সামগ্রিক সংকট, অনুন্নয়ন ও সামাজিক পশ্চাৎপদতার কারণেই আমাদের দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে গুরুতর ও জটিল সমস্যার আকার ধারণ করেছে। আমলাতান্ত্রিক, গণবিমুখ ও দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসন ব্যবস্থা দেশের অগ্রগতির পথে একটি প্রধান বাধা। শাসকগোষ্ঠীর লুটপাটের স্বার্থে আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বিচার বিভাগের সংস্কার না করে, তার স্বাধীনতা লংঘন করে তাকে নানাভাবে কলুষিত করা হচ্ছে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাজ বিকাশের ভিত্তিমূলে আঘাত হানা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি ঘটছে। কালো টাকার মালিক, দুর্নীতিবাজ, সামরিক-বেসামরিক আমলা, রাজনীতিবিদ ও সন্ত্রাসী শক্তিগুলোর সহযোগে দেশে আজ শক্তিশালী মাফিয়া চক্র গড়ে উঠছে। রাষ্ট্র, রাজনীতি, গণসংগঠন ও বিভিন্ন সমাজ সংগঠনে এদের দোর্দ- প্রতাপ। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি সমাজকে দূষিত করছে এবং অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নিরক্ষরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কুশিক্ষা ও কুসংস্কারকে মদদ দেয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষের পুষ্টিহীনতা, স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি, দারিদ্র, বৈষম্য গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করছে। সার্বজনীন শিক্ষা, বিজ্ঞান চেতনার প্রসার, মানবিক-গণতান্ত্রিক-লোকায়ত ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পরিবর্তে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, পশ্চাৎপদতা, রক্ষণশীলতা, কূপমন্ডুকতা, কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস, মৌলবাদ, অপসংস্কৃতি, ভোগবাদ, নারী নির্যাতন, মাদকাসক্তি ইত্যাদিকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। ভোগসর্বস্ব পুঁজিবাদের আরোপিত উন্নয়ন ধারা প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে, মানুষের প্রকৃত সুখ কেড়ে নিয়ে ভারসাম্যহীন, বিকৃত ও আত্মঘাতী এক সমাজের দিকে আমাদের মাতৃভূমি ও আগামী প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে ঔপনিবেশিক সামন্তবাদী অতীত থেকে চলে আসা উৎপাদন কাঠামোর অবশেষসমূহ টিকে থাকলেও, ধনবাদই গ্রামীণ অর্থনীতির মুখ্য ধারায় পরিণত হয়েছে। গড়ে উঠেছে গ্রামীণ বুর্জোয়া শ্রেণী। খাদ্যসংকট অব্যাহত থাকছে, কৃষক উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, ধনী কৃষক সংকটে, মধ্য কৃষক পরিণত হচ্ছে গরিব কৃষকে, ক্ষুদে চাষী ভূমি হারিয়ে পরিণত হচ্ছে ক্ষেতমজুরে। ক্রমেই গভীর হচ্ছে নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া। তাঁতী, জেলে, কামার, কুমার, গ্রামীণ বৃত্তিজীবীরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গ্রামে কৃষক-ক্ষেতমজুরসহ সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিঃশ্বাস উঠেছে। এরা অধিকাংশই মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। আমলা, মুৎসুদ্দি, ধনিক গোষ্ঠীর সহযোগিতায় গ্রামাঞ্চলে গড়ে উঠেছে এক নব্য শোষক-কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। এই সব গোষ্ঠীর সাথে সংঘাত দেখা দিচ্ছে গ্রামাঞ্চলের সকল শ্রেণী ও স্তরের জনগণের। মুক্তির পথ সমাজতন্ত্র যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশের মানুষ শোষণমুক্তি, সাম্য ও সমৃদ্ধ জীবনের যে স্বপ্ন অন্তরে লালন করে এসেছে, সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ হলো সমাজতন্ত্রের পথ। অভিজ্ঞতাই প্রমাণ করেছে যে, সাম্রাজ্যবাদ-ধনবাদই হলো আমাদের দেশবাসী এবং জাতীয় জীবনের সংকটের মূল কারণ। দুনিয়ার অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে যে, ধনবাদ সমাজ বিকাশের এক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও, মানুষের শোষণমুক্তি, সাম্য ও সুষম বিকাশের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো- যারা ধনবাদের পথ অনুসরণ করছে, এইসব দেশের প্রসঙ্গ বাদ দিলেও, উন্নত ধনবাদী দেশসমূহের জনগণের জীবনেও অব্যাহত রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সংকট, অশান্তি ও অবক্ষয়। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত ধনবাদী দেশগুলোতেও সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষণ, বঞ্চনা, সন্ত্রাস, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, ব্যবসা সংকট, দ্রুত হারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মানুষে মানুষে বৈষম্য, নারীর মর্যাদাহীন পণ্যে রূপান্তর, বর্ণবাদ, অস্থিরতা, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, আত্মকেন্দ্রিকতা ও বিচ্ছিন্নতা জনসাধারণের জীবনে স্থায়ী অভিশাপ হিসাবে বিরাজ করছে। ধনবাদী বুর্জোয়া সমাজের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ আজ চরমভাবে অধঃপতিত। ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, উত্তেজনা, সন্ত্রাস, যুদ্ধ এবং অকল্পনীয় অর্থের বিনিময়ে বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক আবিষ্কারসমূহ ব্যবহার করে অভাবনীয় পারমাণবিক সমরসজ্জা তথা যুদ্ধ আর ধ্বংসের পথ হচ্ছে ধনবাদ-সাম্রাজ্যবাদের পথ। ‘মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ’ তথা সাম্যবাদের পথে, মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার পথে সমাজতন্ত্র হলো এক আবশ্যিক অন্তর্বর্তীকালীন পর্ব। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা- যার মূল বাণী হলো ‘সবকিছু মানুষের জন্য, সবকিছু মানুষের মঙ্গলের জন্য।’ ‘প্রতিটি মানুষের মুক্ত বিকাশই হচ্ছে সকলের মুক্ত বিকাশের পূর্ব শর্ত।’ সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রক্ষমতায় জনগণের সমর্থনপুষ্ট শ্রমিক শ্রেণী ও মেহনতি মানুষের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণের রায়, সমর্থন ও আস্থাই হচ্ছে এই নেতৃত্বের উৎস ও ভিত্তি। শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণের সক্রিয় সমর্থন ও আস্থা ছাড়া সমাজতন্ত্র অগ্রসর হতে পারে না। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য হচ্ছে উৎপাদনের প্রধান প্রধান উপায়গুলোর ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা, মানুষের ওপর মানুষের শোষণের অবসান এবং সামাজিক নির্যাতন, সুবিধাভোগী সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর শাসনের অবসান এবং ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, বেকারত্ব থেকে মুক্তি। সমাজতন্ত্র উৎপাদন শক্তি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরিকল্পিত সুষম মানবিক ও পরিবেশসম্মত বিকাশের প্রভূত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। ‘প্রত্যেকে কাজ করবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী এবং প্রত্যেকে পাবে তার কাজ অনুযায়ী’- এই নীতির ভিত্তিতে ন্যায্য মজুরি, খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও অন্যান্য সামাজিক সুবিধাদির নিশ্চয়তা বিধান, নারীমুক্তি, জাতীয় ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য দূর করা এবং সুষম বিকাশের অধিকার নিশ্চিত করা, মানুষের ধর্মপালনসহ যে কোনো মত, বিশ্বাস, বিবেকের স্বাধীনতা ও বহুত্ববাদ, দল ও সংগঠন করার অধিকার, গণতন্ত্র, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের জন্য জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি বিষয়ে সর্ব পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ ও স্বশাসনের নিশ্চয়তা বিধান, জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা, রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্রম সংকোচন, সম-অধিকারভিত্তিক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সমাজের মানবিক বিকাশ সাধন, সুমহান ঐতিহ্যে সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ সুগম করা, সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে শান্তি, মৈত্রী, সহযোগিতা ও নৈকট্যকে উৎসাহিত করা। মানবাধিকার, মানবিক মর্যাদা, সার্বজনীন মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা প্রভৃতির প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও সুরক্ষা সমাজতন্ত্রের কর্তব্য ও লক্ষ্য। সমাজতন্ত্র জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এই ধরিত্রীর মানুষের শোষণমুক্তি, স্বাধীন ও মুক্ত বিকাশ, বিশ্বমানবতার মহামিলনের ভিত্তি রচনা করে। সমাজতন্ত্র প্রতিনিয়ত ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করে নানা বৈচিত্র্যময় পথে সৃজনশীলভাবে মানবজাতির সুখী-সুন্দর জীবনের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার দিকে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি জনগণের প্রকৃত কল্যাণ ও মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে প্রয়োজন দেশের পশ্চাৎপদ আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবসান ঘটানো এবং সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পূর্বশর্ত সৃষ্টি করা। কিন্তু দেশের চলমান ধনবাদী বিকাশের সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে থেকে এই লক্ষ্য পূরণ করা অসম্ভব। অপরদিকে এই মুহূর্তে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের পূর্বশর্তগুলোও পরিপক্ক হয়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় সংকট মোকাবেলা করে মুক্তির পথে অগ্রসর হওয়া এবং সমাজতন্ত্রের পূর্বশর্তগুলো সৃষ্টি করার জন্য দেশের বর্তমান অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন সাধন তথা বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধন করতে হবে। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা, অনুন্নয়ন ও পশ্চাৎপদতা দূর করে সমাজ-সংগঠন ও সমাজ-কাঠামোর বিকাশ ঘটানো এবং সমাজতন্ত্রের ভিত রচনা করা এই মুহূর্তের প্রধান কর্তব্য। সাম্রাজ্যবাদনির্ভর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বজায় থাকার কারণে, আমাদের দেশের জাতীয় উন্নয়ন ও সামাজিক বিকাশের মাত্রা অতি নিচু স্তরে রয়ে গেছে। এই অবস্থার অবসান ঘটানো এবং দেশের উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ অবাধ করার লক্ষ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সার্বিক গণতন্ত্রায়ন এবং সম্পদের অধিকতর সুষম বণ্টন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সম্পন্ন করতে হবে। বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের মাধ্যমে গণতন্ত্রায়ন, উপযুক্ত বিকেন্দ্রীকরণ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনগণের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও অংশগ্রহণের নিশ্চয়তার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও কাঠামোকে মৌলিকভাবে ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা করা হবে। জাতীয় স্বাধীনতা সংহত করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ’৭২-র সংবিধানের মূল ভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আমলাতন্ত্রের অবসান, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এবং প্রতিটি নাগরিকের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা, কাজের অধিকার, পূর্ণ মৌলিক নাগরিক অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারসহ সংগঠন করার অধিকার, স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার, বাক্-ব্যক্তি-সংবাদপত্র-সাংবাদিকতা-চিন্তা-বিবেকের স্বাধীনতা ইত্যাদি নিশ্চিত করা হবে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রভৃতির আরোপিত তথাকথিত ‘অবাধ মুক্তবাজার অর্থনীতির’ পথ পরিত্যাগ করে, সুদক্ষ রাষ্ট্রীয় খাতকে নিয়ামক রেখে মিশ্রখাত, সমবায়ী খাত ও ব্যক্তিগত খাতের যথাযথ ভূমিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্বাধীন আত্মনির্ভরশীল অর্থনৈতিক বিকাশের প্রগতিশীল পথ গ্রহণ করা হবে। উৎপাদনবিমুখ, পরজীবী, আমলা, মুৎসুদ্দি, কালো টাকা ও লুটেরা পুঁজির কর্তৃত্ব দূর করে, পরিবেশ ও প্রকৃতির অনুকূল প্রকৃত উন্নয়ন ও জনকল্যাণে কৃষি ও কৃষিসহ সর্বক্ষেত্রে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ নিশ্চিত করা হবে। শিল্পায়নের লক্ষ্যের পাশাপাশি গ্রাম ও গরিব অভিমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনার ধারা গ্রহণ করা হবে। দেশের ব্যাপক বেকার জনগণের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার কাজটিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রাথমিক কর্তব্য রূপে গ্রহণ করা হবে। এই মূল কর্তব্যকে কেন্দ্র করে একাধারে জাতীয় উৎপাদনের মাত্রা প্রভূতভাবে বৃদ্ধি ও সাথে সাথে ব্যাপক দেশবাসীর জীবনযাত্রার মান ন্যূনতম পর্যায়ে উন্নীত করা ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির দ্বারা অভ্যন্তরীণ বাজারের প্রসার নিশ্চিত করা যাবে। অপচয় রোধ, ভোগবাদী প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বৃদ্ধি ও বিনিয়োগের জন্য সম্পদ সংগ্রহের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বাড়ানো হবে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে এবং বৈষম্যহীন নয়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে দৃঢ় প্রয়াস চালানো হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি ও গ্রাম জীবনের আমূল বিপ্লবী পুনর্গঠন, খোদ কৃষকের হাতে জমি ও স্বেচ্ছামূলক সমবায়-এই নীতির বাস্তবায়ন, খোদ কৃষকের জন্য লাভজনক পণ্যমূল্যের নিশ্চয়তা, ক্ষেতমজুরদের কাজ, গ্রামীণ ও কুটির শিল্প এবং বহুমুখী সার্ভিসের প্রসার, কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা স্কিম ও দারিদ্র বিমোচনের কার্যক্রম বাস্তবায়নের গুরুত্ব দেয়া হবে। গ্রামীণ উন্নয়ন নিশ্চিত করে মানুষের শহরমুখীনতা কমানো, শহর ও গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাপক গৃহায়ন প্রকল্প, নগর জীবনের পৌর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, গণমুখী স্বাস্থ্যনীতি ও ঔষধনীতি চালু, বিশুদ্ধ পানীয়, স্যানিটেশন ও রোগ প্রতিষেধক ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি, ভোগবাদ, পশ্চাৎপদ চিন্তার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল সংস্কৃতি বিকাশের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হবে। নারী সমাজের উপর বৈষম্য ও নির্যাতন বন্ধ করে সমাজে তাদের অধিকার ও যোগ্য ভূমিকা নিশ্চিত করা, শিশু-কিশোরদের স্নেহ-মমতা ও যত্নে আগামী শতাব্দীর সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর বৈষম্য দূর করে সম্পত্তি, অধিকার ও সামাজিক জীবনে সম মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করা এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চোরাচালানি, কালোবাজারি প্রভৃতি অপরাধ দমনে কঠোরতম ব্যবস্থা কার্যকর করা হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বশান্তি, পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ও দেশে দেশে সম্পর্কের গণতন্ত্রায়ণ, স্বাধীন ও সক্রিয় জোট নিরপেক্ষ নীতি এবং দক্ষিণ-এশীয় ও আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করা, সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, নব্য নাৎসিবাদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও আন্তর্জাতিক সংহতি শক্তিশালী করতে প্রয়াস চালানো হবে। এসব মূল দৃষ্টিভঙ্গী ও নীতি অবলম্বনে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে গতিশীল অথচ সুনির্দিষ্ট অধিকতর বিস্তৃত কর্মসূচি প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মাঝামাঝি কোনো নতুন সমাজ ব্যবস্থা নয়, এটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন গতিশীল পর্যায় বা বিপ্লবী প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া সনাতন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার গন্ডিকে অতিক্রম করার মাধ্যমে একাধারে বুর্জোয়া বিকাশের অসমাপ্ত কর্তব্য সম্পাদন করবে, সাথে সাথে সমাজতন্ত্রের পূর্বশর্ত সৃষ্টি করবে। বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া কঠোর ও কঠিন প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কারণ এই প্রক্রিয়া সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্রে গুণগত পরিবর্তন সাধন করবে। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আমলা-মুৎসুদ্দি লুটেরা শোষক গোষ্ঠী এবং বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ খুব স্বাভাবিকভাবে এই প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করতে সক্রিয় হবে। তাই এই প্রক্রিয়া অগ্রসর করে নেয়ার ক্ষেত্রে সংগ্রাম গড়ে তোলায় নমনীয় ও কৌশলী, অথচ নীতিতে দৃঢ় হতে হবে। বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সফল করতে জনগণের সমর্থন, সচেতনতা ও বিপ্লবী প্রক্রিয়া একান্ত আবশ্যক। কারণ এই বিপ্লবী প্রক্রিয়া অগ্রসর করে নেয়ার ক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধক বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদনির্ভর আমলা-মুৎসুদ্দি, লুটেরা, কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীকে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবন থেকে রাজনৈতিকভাবে উচ্ছেদ ও পরাভূত করতে হবে। তাই এই কর্তব্য পালনে দৃঢ় ও অবিচল শক্তি হিসেবে কমিউনিস্ট, বাম, প্রগতিশীল ও গণতন্ত্রীদের মিলিত একটি ফ্রন্ট বা মোর্চা গড়ে তুলতে হবে। নানা অভিজ্ঞতা, সমস্যা, সম্ভাবনা ও জটিলতার মধ্য দিয়ে এই ধরনের ঐক্য বা ফ্রন্টকে ক্রমেই সুংসহত, গণভিত্তিক ও প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পার্টির নিরবচ্ছিন্ন দৃঢ় ও ধৈর্যশীল প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি শরিক শক্তিসমূহকে তার ইতিহাস নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে অবশ্যই সক্ষম ও যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। কমিউনিস্ট, বাম ও গণতন্ত্রীদের এই মোর্চা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়ে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধনের জন্য শক্তি-সমাবেশ বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন যেহেতু জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটায় এবং এই প্রক্রিয়া যেহেতু উৎখাত করে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর আমলা-মুৎসুদ্দি ও লুটেরা ধনিক, জোতদার মহাজনের মতো সামন্তঅবশেষ হিসেবে বিদ্যমান সকল ক্ষয়িষ্ণু শক্তি, গ্রামাঞ্চলে গজিয়ে ওঠা নব্য কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীসহ সকল প্রতিক্রিয়াশীল শাসন-শোষণ, সেহেতু এই প্রক্রিয়ার সফল বাস্তবায়নে ব্যাপক শ্রেণী ও স্তরের স্বার্থ ও ভূমিকা একই রকম হবে না। শ্রমিক শ্রেণী আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার প্রধান শক্তি। তার মৌলিক স্বার্থ দেশ জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। নানা দুর্বলতা সত্ত্বেও, আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণী গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে দেশের শ্রমিক শ্রেণী সুসঙ্গত ও বিপ্লবী ভূমিকা পালন করবে। গ্রামাঞ্চলে বিশাল ক্ষেতমজুর জনগোষ্ঠী মূলত গ্রামীণ সর্বহারা। এরা আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণীর সহোদর। গ্রামের ক্ষেতমজুর ও শহরের শ্রমিক শ্রেণীকে সচেতন ও সংগঠিত করতে পারলে, বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে এরা অগ্রবাহিনীর ভূমিকা পালন করবে। নির্মমভাবে শোষিত প্রান্তিক কৃষক, বর্গাচাষী ও মধ্যকৃষক তথা মেহনতি কৃষক হবে এই বিপ্লবী প্রক্রিয়ার অপর এক বলিষ্ঠ উপাদান। শ্রমিক শ্রেণী, ক্ষেতমজুর ও মেহনতি কৃষকের মধ্যে ঐক্য-সংগঠন ও বিপ্লবী জাগরণ সৃষ্টি করে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে এদের চালিকা শক্তিতে পরিণত করতে হবে। সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের মেহনতি মানুষ, ছিন্নমূল ভাসমান জনগোষ্ঠী নানা জটিলতা সত্ত্বেও, এই বিপ্লবী প্রক্রিয়ার পক্ষের এক জঙ্গি শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের মধ্যস্তরের জনগণ, বিশেষত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও পেশাজীবীরা এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দেশের ক্ষুদে উৎপাদক শ্রেণী তথা কৃষক সমাজের বৃহত্তর অংশ, কারিগর, স্বনিয়োজিত উদ্যোক্তা প্রমুখের ভূমিকাও হবে গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে ক্ষুদে, মাঝারি, বৃহৎ প্রভৃতি স্তর বিদ্যমান। তাদের মধ্যে জাতীয় বুর্জোয়ার ধারা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী, মুৎসুদ্দি ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী ধারাও। এই ধারাগুলোর বিভাজন এখনো অসম্পূর্ণ এবং কখনো কখনো জড়াজড়ি করে বিরাজ করছে। ক্ষুদে ও মাঝারি বুর্জোয়া এবং সাধারণতভাবে জাতীয় বুর্জোয়ার ধারায় বিকাশমান বুর্জোয়া শ্রেণী নানা দোদুল্যমানতাসহ বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে অবদান রাখার সম্ভাবনা বহন করে। তাদেরকে স্বপক্ষে রাখার জন্য এবং ন্যূনপক্ষে নিরপেক্ষ রাখার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে শত্রুর ভূমিকায় থাকবে সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ এবং এদের সহযোগী আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজির মালিক, লুটেরা ধনিক গোষ্ঠী এবং গ্রামাঞ্চলের পরগাছা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীসহ মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। এ ছাড়াও যারা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সুবিধাভোগী, লুটেরা ধনিক শ্রেণীর তাঁবেদার ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারার অনুসারী এরাও এই বিপ্লবী প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করবে এবং শত্রুর ভূমিকায় থাকবে। বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধনে পার্টির ভূমিকা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সৃজনশীল প্রয়োগের মাধ্যমে পার্টি এই লক্ষ্যকে অগ্রসর করার জন্য এবং বিরাজমান বাস্তবতার আলোকে তার চলমান কর্তব্যসমূহ নির্ধারণে পার্টিকে সব সময় সচেষ্ট থাকতে হবে। সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যের পাশাপাশি পার্টির সামনে রয়েছে বর্তমান সময়ের বিশেষ কর্তব্য। এ সময়কালে পার্টির কর্মসূচি সমাজতন্ত্র অভিমুখী বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সম্পন্ন করার লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। কর্মসূচি চূড়ান্ত লক্ষ্যের পথে অগ্রসর করার স্বার্থেই এবং সেই লক্ষ্যের কথা বিস্মৃত না হয়েই বর্তমানে পার্টির সার্বিক কর্মপ্রচেষ্টার প্রধান বিষয়বস্তু হলো এই কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন। পার্টির কাজ হবে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে একাগ্র, সুদৃঢ় ও উদ্যোগী শক্তি হিসেবে সামগ্রিকভাবে ও দায়িত্বশীলতার সাথে অগ্রসর করা। সেজন্য পার্টিকে দেশের ব্যাপক শ্রেণী ও স্তরের জনগণ এবং সমগ্র জাতির সাধারণ স্বার্থের চ্যাম্পিয়ন হতে হবে। একই সাথে, সমগ্র প্রক্রিয়ায় অগ্রগতির ধারাতে পার্টিকে বিশেষভাবে দেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে এবং এই প্রক্রিয়ায় তাদের অবদান ও ভূমিকা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। পার্টিকে নির্দিষ্ট মুহূর্তের বাস্তবতা, শক্তির ভারসাম্য ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংগ্রাম অগ্রসর করতে হবে। এসব কাজ অগ্রসর করার জন্য পার্টির স্বাধীন উদ্যোগ ও ভূমিকা অব্যাহত রাখতে হবে। দেশের বর্তমান মৌলিক সমস্যাবলীর মূলগত সমাধানের জন্য সমাজের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধনের লক্ষ্যে, জাতীয় উজ্জীবনের বিপ্লবী আহ্বানকে পার্টির উদ্যোগে সর্বস্তরের মানুষের কাছে যথাসম্ভব স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। দেশের সম্ভাব্য রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে উপরোক্ত মৌলিক চিন্তার যতটা সম্ভব কাছাকাছি আনার জন্য এবং এসব বিষয়ে সাধারণ ঐকমত্য ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য পার্টির উদ্যোগকে বিশেষভাবে কার্যকর করতে হবে। আমাদের দেশবাসী ধর্মপ্রাণ। দেশের জনগণের বিপুলতম অংশ হলো ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এ ছাড়াও হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান প্রভৃতি ধর্মাবলম্বীরাও আছেন। কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রাম ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। কমিউনিস্টরা জনগণের কল্যাণ, শান্তি, মানবতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে- সেগুলো ধর্মের মধ্যেও আছে। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলো প্রগতির ধারাকে প্রতিহত করার হীন স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে। পার্টি ধর্মের এ রূপ অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করবে। দেশের রাজনৈতিক সংগ্রামে ও গণমানুষের নানাবিধ দৈনন্দিন সংগ্রামে দৃঢ়, সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন এবং সেই সাথে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনা নির্ধারণের প্রয়াসের মাধ্যমেও পার্টির স্বাধীন ভূমিকাকে স্পষ্ট করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। পার্টির বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের ধারা ও প্রক্রিয়া অগ্রসর করার জন্য দেশে একটি বাম-গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার অনুকূলে শক্তি-সমাবেশ ও ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিকে এ রূপ সরকার প্রতিষ্ঠাকল্পে উপর্যুক্ত কৌশলে ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে এবং সেই সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে, তার কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিশেষভাবে সচেষ্ট ও উদ্যোগী হতে হবে। বাম-গণতান্ত্রিক সরকারের নেতৃত্বে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের সূচনার আগেও, রাজনৈতিক ক্ষমতায় নানা উত্থান-পতন ও পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই সমস্ত জাতীয় রাজনৈতিক পর্বে পার্টি তার মূল লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে স্বাধীন নীতিনিষ্ঠ অবস্থান অনুসরণ ও সক্রিয় ভূমিকা পালনে সচেষ্ট থাকবে এবং ঐক্য ও সংগ্রামের কৌশলটি সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এমন মূর্ত ও সৃজনশীল কায়দায় প্রয়োগ করবে, যাতে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের দিকে যাত্রা অব্যাহত ও ত্বরান্বিত হয়। এসব কাজ অধিকতর বলিষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য এবং একই সাথে ভবিষ্যতের আরো বৃহত্তর বিপ্লবী কর্তব্য ও চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের কথা বিবেচনায় রেখে, পার্টির গণভিত্তি প্রসারিত করে পার্টিকে গুণ, মান, শৃঙ্খলা, নিষ্ঠায় উন্নত ও শক্তিশালী করার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। এই বিবেচনায় কমিউনিস্ট ঐক্যের জন্য পার্টিকে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। পার্টির বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের স্বপক্ষের রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তি এবং ব্যক্তির বৃহত্তর সমঝোতা ও ঐক্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এই লক্ষ্যে পার্টিকে এসব শক্তি ও ব্যক্তির মধ্যে যাদেরকে নিয়ে সম্ভব তাদের সমন্বয়ে একটি বাম-গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তোলার জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগী হতে হবে। পার্টির ঐক্যবদ্ধ শক্তি-সমাবেশের অভ্যন্তরে যুক্তিগ্রাহ্য ও বাস্তবসম্মত ভূমিকা পালনের জন্য এবং ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধির জন্য সব সময় সচেষ্ট হতে হবে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ায় কর্মপ্রচেষ্টায় নিয়োজিত হতে হবে এবং এভাবে জাতি ও জনগণের সামনে উপস্থিত বাস্তব কর্তব্যগুলো দায়িত্বপূর্ণভাবে যথাসম্ভব অগ্রসর করতে সচেষ্ট হতে হবে। পার্টিকে ‘ভাত-কাপড়-জমি-কাজ’ এই শ্লোগান নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও অংশের সাধারণ মানুষের ন্যায্য অর্থনৈতিক-সামাজিক দাবিসমূহ আদায় এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা-সংকট নিরসনের জন্য আংশিক ও স্থানীয় আন্দোলন-সংগ্রামসমূহ গুরুত্বের সাথে অগ্রসর করতে হবে। এই কাজের মাধ্যমে তাদের অবস্থার যথাসম্ভব উন্নতি বিধান এবং তাদেরকে সচেতন, সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করার জন্য পার্টিকে নিরলসভাবে সচেষ্ট হতে হবে। দেশ আজ এক সর্বগ্রাসী সংকটের কবলে। ক্রমাগত অধোগতির ধারা ও সার্বিক অবক্ষয় আজ সমগ্র জাতির অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছে। এই সর্বগ্রাসী সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির ধারা উজ্জীবিত করা দেশবাসীর সামনে আজ এক সাধারণ কর্তব্য হিসেবে উপস্থিত। একমাত্র শাসকগোষ্ঠী ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী, লুটেরা ব্যক্তি ব্যতীত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের স্বার্থই এই কর্তব্য সম্পাদনের সাথে জড়িত রয়েছে। তাই আজ দেশের সংকট মোকাবেলায় বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধন করা সমগ্র জাতির সামনে এক মহান দেশপ্রেমিক কর্তব্য হিসেবে উপস্থিত। এই কর্তব্য একক কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে, এমনকি কেবল রাজনীতিবিদদের পক্ষেও এককভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। সমগ্র জাতির সর্বস্তরের জনগণের সম্মিলিত শক্তি-সামর্থের সম্মিলন এবং বাস্তবতার নিরিখে তার সৃজনশীল প্রয়োগের মাধ্যমে এই কর্তব্য সম্পাদন করা সম্ভব। সেজন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা আজ প্রতিটি দেশপ্রেমিক শক্তি ও ব্যক্তির পবিত্র কর্তব্য হয়ে উঠেছে। আমাদের আছে সুমহান সংগ্রামী ঐতিহ্য, আছে অতীত অনেক গৌরবগাঁথা। মুক্তিযুদ্ধকালে সমগ্র জাতির ঐক্য, অপরিসীম ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা আমরা ছিনিয়ে এনেছি। আজ নতুন করে সে রূপ জাতীয় উজ্জীবনের কর্তব্য আমাদের সামনে উপস্থিত। আজ পুনরায় সমগ্র জাতির সকল দেশপ্রেমিক শ্রেণী, স্তর ও ব্যক্তির সম্মিলিত প্রয়াস, শক্তি-সম্পদ-মেধা ও সমবেত সংগঠন-শক্তির মাধ্যমেই জাতীয় উজ্জীবনের কর্তব্য সম্পাদিত হতে পারে। বীরের এই জাতির পক্ষে বিজয় ছিনিয়ে আনা কঠিন কাজ নয়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি দেশবাসীর কাছে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধন করার সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে। উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে, বর্তমান পর্যায়ে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সম্পন্ন করার জন্য যেসব আশু, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে হবে, তার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা ধারাবাহিকভাবে ১৭টি উপ-শিরোনামে নিচে তুলে ধরা হলো। আমরা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের মৌলিক ধারণার ভিত্তিতে প্রণীত বর্তমান পর্যায়ের এই কর্মসূচিটি পরিবর্তনশীল, বিষয়গত ও বিষয়ীগত বাস্তবতার আলোকে ক্রমেই আরো সুনির্দিষ্ট রূপ ধারণ করবে এবং জনগণকে এর ভিত্তিতে সংগঠিত করার মধ্য দিয়েই জনগণ অবশেষে একটি সমাজ পরিবর্তনের বস্তুগত শক্তিতে পরিণত হবে। বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের ১৭ দফা কর্মসূচি ১. রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও রাজনীতি (ক) জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংহত করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের চার রাষ্ট্রীয় মূল নীতি নিষ্কলুষভাবে বহাল রেখে ও অসম্পূর্ণতা দূর করে ’৭২-এর সংবিধানের মূল ভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। (খ) বাঙালি জাতি ও অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষের স্বকীয় বিকাশকল্পে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার প্রগতিশীল প্রসার দৃঢ়মূল করা এবং সাথে সাথে অন্যান্য জাতিসত্তার বিকাশের অধিকার রক্ষা করা। আদিবাসী ও সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষের অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া। (গ) সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণের সার্বভৌমত্ব ও যথাযথ কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রশাসনিক কাঠামো (১) গণতন্ত্র, (২) উপযুক্ত বিকেন্দ্রীয়করণ, (৩) স্বচ্ছতা, (৪) জবাবদিহিতা, (৫) জনগণের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও অংশগ্রহণ- এই নীতিমালার ভিত্তিতে মৌলিকভাবে ঢেলে সাজানো। উপজেলাকে রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক কাজের মুখ্য কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। গ্রাম, ইউনিয়ন, থানা ও জেলা স্তরে স্থানীয় স্বশাসিত সরকার কাঠামোকে আর্থিক ক্ষমতাসহ রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাজের দায়িত্ব ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত করে অর্পণ করা। সকল স্তরের প্রশাসনিক কাঠামোতে আমলাতান্ত্রিকতা দূর করা এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাজকর্মের ওপর স্ব-স্ব স্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। জাতীয় সংসদ সদস্যদের পরিবর্তে নির্বাচিত স্থানীয় স্বশাসিত সরকার কাঠামো সংস্থার হাতে স্ব-স্ব স্তরের প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কর্মকান্ডের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির দায়িত্ব অর্পণ করা। জাতীয় সংসদের ওপর রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ও কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের তদারকির কাজ ন্যস্ত রাখা। (ঘ) কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কোনো তথ্য ব্যতীত অন্য সব তথ্য অবগত হওয়ার ক্ষেত্রে সব রকম বিধি-নিষেধ তুলে নেয়া এবং রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক কার্যক্রম যেন সাধারণ মানুষ পূর্ণভাবে অবগত হতে পারে সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। (ঙ) চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ করার লক্ষ্যে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। সরকারি সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর উপর জনগণের কার্যকর গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা ও বেতার-টিভিকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। (চ) সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা। বিশেষ ক্ষমতা আইন, নিরাপত্তা ও নিবর্তনমূলক আটক আইন, প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অ্যাক্ট, চলচ্চিত্র সংসদ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, বিভিন্ন ধরনের সেন্সরশিপ, অবাধ মত প্রকাশ ও মুক্তচিন্তার অধিকার হরণ, ধর্মঘট নিষিদ্ধকরণ আইনসহ মৌলিক অধিকার খর্বকারী সকল কালা কানুন বাতিল করা। ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করা আচরণ শাস্তিমূলক অপরাধ বলে গণ্য করার ব্যবস্থা করা। সকল নাগরিকের জন্য অবাধে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা ও সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করা। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করা। ১৯৭৩ সালের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে গঠিত ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করা ও দন্ডপ্রাপ্তদের শাস্তি দ্রুত কার্যকর করা । (ছ) গণতন্ত্রের ধারায় জনগণের কাছে দায়বদ্ধ ও সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য, দক্ষ, আধুনিক ও কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনীতি-নিরপেক্ষ রাখা এবং রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অসাংবিধানিক কাজে ব্যবহার রোধের ব্যবস্থা করা। রাজনীতি ও প্রশাসনিক কাজে গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের তৎপরতা ও হস্তক্ষেপ রোধের ব্যবস্থা করা। (জ) আমলাতান্ত্রিকতা মুক্ত, দক্ষ, নিরপেক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক প্রশাসন গড়ে তোলা। সকল স্তরের প্রশাসনের ক্ষেত্রে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা এবং প্রশাসনের ওপর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। (ঝ) সকল সময়ের জন্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। প্রতিটি ভোটার যেন লোভ-লালসা ও ভয়মুক্তভাবে নিজ স্বাধীন ইচ্ছা অনুসারে ভোট প্রদান করতে পারে এবং কারচুপিমুক্তভাবে যেন তার রায় প্রকাশিত হয় তা নিশ্চিত করা। নির্বাচনকে অর্থ ও পেশীশক্তির প্রভাব মুক্ত করা। খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের জাতীয় নির্বাচনসহ যে কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করা। নির্বাচনী ব্যয়ের সীমা কমিয়ে আনা ও নির্বাচন বিধির কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলসমূহের প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি প্রবর্তন করা। জনগণের কাছে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে ভোটার কর্তৃক যে কোনো সময়ে নির্বাচিত প্রতিনিধি প্রত্যাহার করার এবং পুনর্নির্বাচনের অধিকার ও ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। উপরোক্ত ব্যবস্থাসমূহের ভিত্তিতে নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করা। (ঞ) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা এবং সেজন্য প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগকে পরিপূর্ণ রূপে পৃথক করা। ম্যাজিস্ট্রেসিকে বিচার বিভাগের অধীনস্থ রাখা। উপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে রচিত বর্তমান ফৌজদারি, দেওয়ানি কার্যবিধি ও দন্ডবিধির গণতান্ত্রিক চেতনায় যুগোপযোগী সংস্কার সাধন। আধুনিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে কারাগার সংক্রান্ত আইন ও বিধি ব্যবস্থা সংস্কার করা। (ট) সকল রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিচার করা। আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করা। (ঠ) সামরিক শাসন, একনায়কত্ব ও স্বৈরশাসনের বিপদ দূর করার জন্য এসব প্রবণতার উপাদান ও ভিত্তি নির্মূল করা। বহুদলীয় সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা সংহত করা ও সাংবিধানিক ভিত্তিতে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের ধারা স্থায়ী করা। (ড) আইএলও কনভেনশন মোতাবেক শ্রমিক-কর্মচারী, ক্ষেতমজুরসহ শ্রমজীবী জনগণের পূর্ণ ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারসহ অন্যান্য অধিকার নিশ্চিত করা। ট্রেড ইউনিয়নগুলোর উপর মাফিয়া গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি-মাস্তানি, ট্রেড ইউনিয়ন আমলতান্ত্রিকতা দূর করে সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারী-ক্ষেতমজুর-শ্রমজীবীদের স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী প্রকৃত স্বার্থের স্বপক্ষে সুস্থ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে তোলা। শিল্প পুলিশ বাতিল করা। (ঢ) প্রতিটি নাগরিকের জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের অধিকারকে মৌলিক নাগরিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করে তা নিশ্চিত করতে ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হওয়া। উন্নয়নের সুফল যাতে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও উপরোক্ত মৌলিক অধিকারসমূহ পূরণের ধারায় অগ্রসর হয় তার ব্যবস্থা করা। (ণ) সকল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে মজবুত করা, গণতান্ত্রিক বিকাশের প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা, গণতান্ত্রিক চেতনা, সংস্কৃতি ও চর্চার প্রসার ঘটানো, রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের সম্পৃক্তি বৃদ্ধি করা এবং গণতন্ত্রকে গভীরতর করার জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ণের ধারা প্রসারিত করে সমাজ জীবনের সার্বিক গণতন্ত্রায়ণের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক-সংস্কৃতির প্রসার ঘটানো। ২. অর্থনীতি (ক) দেশের অর্থনৈতিক লক্ষ্য, নীতি-নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে পরনির্ভরতা দূর করে নিজেরাই নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থা করা। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ প্রভৃতি দাতা সংস্থা ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর চাপিয়ে দেয়া তথাকথিত ‘অবাধ ও খোলাবাজার অর্থনীতি’র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা। এই ব্যবস্থার ফলে অর্থনীতিতে যে পরনির্ভরতা, উৎপাদনবিমুখ ফটকাবাজি প্রবণতা, পরজীবী-পরগাছা পরায়ণতা, আমলা-মুৎসুদ্দি লুটেরা পুঁজির অশুভ কর্তৃত্ব ও কালো টাকা নির্ভর লুটপাটের ব্যবস্থা চলছে, তার বিলোপ সাধন করা। এই ব্যবস্থার বিকল্পে আত্মনির্ভরশীল-উন্নয়নমুখী ধারায় জনগণের কল্যাণ ও জাতীয় অগ্রগতির লক্ষ্যে কৃষি ও শিল্পসহ সর্বক্ষেত্রে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ নিশ্চিত করা। সকল মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির দ্বারা দেশের বিপুল জনশক্তির সৃজন ক্ষমতা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর ভিত্তিতে উৎপাদনের অন্যান্য সব সম্ভাব্য উপাদানের সবচেয়ে দক্ষ ও উপযোগী ব্যবহার নিশ্চিত করা। অর্থনীতির ধারাবাহিক বিকাশ নিশ্চিতকল্পে রাষ্ট্রের দক্ষ প্রগতিশীল ভূমিকা গড়ে তোলা এবং অর্থনীতিতে সামগ্রিক দক্ষতা, সামাজিক কল্যাণ, লাভজনকতা প্রভৃতি অর্জনের বিষয়গুলো এক সাথে বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রীয় খাত, সমবায়ী খাত, ব্যক্তি খাত ও মিশ্র খাতসহ প্রতিটি খাতের যথাযথ ও সুপরিকল্পিত ভূমিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্বাধীন অর্থনৈতিক বিকাশের পথকে সুগম করা। অর্থনীতির নিয়ামক খাত হিসেবে দক্ষ রাষ্ট্রীয় খাতের প্রসার ঘটানো। একচেটিয়া লুটেরা অর্থনীতির ধারাকে প্রতিরোধ করে বৈষম্যহীন ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার ধারা নিশ্চিত করা। কালো টাকা ও খেলাপি ঋণ উদ্ধারের ব্যবস্থা নেয়া। আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন সকল কালো সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা। (খ) গ্রামীণ অর্থনীতি ও গ্রামীণ জীবনের আমূল বিপ্লবী পুনর্গঠন করা। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির সুষম বিকাশের কাজে অগ্রাধিকারভিত্তিক গুরুত্ব আরোপ করা। এই লক্ষ্যে কৃষি ব্যবস্থায় বিপ্লবী পরিবর্তন সূচনা করা। ‘খোদ কৃষকের হাতে জমি ও সমবায়’ এই নীতির ভিত্তিতে আমূল ভূমি সংস্কার করা। আবাদযোগ্য কৃষি জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভূমি ব্যবহার নীতি প্রণয়ন করা। অনুপস্থিত ভূমি মালিকানা বাতিল করা এবং জমির সিলিং এক ফসলি ৫০ বিঘা ও দুই ফসলি ৩০ বিঘা নির্ধারণ করে জমির সর্বোচ্চ সিলিং আইন, বর্গাস্বত্ব আইন প্রভৃতির ক্ষেত্রে ফাঁক-ফোকরের সুযোগ বন্ধ করে তার কঠোর বাস্তবায়ন করা। বেনামি জমির মালিকানা বাতিল করা এবং এক মালিকের সব জমি এক খতিয়ানে আনার ব্যবস্থা করা। ভূমি রেকর্ড ব্যবস্থার জটিলতা দূর করে নতুন, উন্নত, স্বচ্ছ, সহজ ও দক্ষ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা। খোদ কৃষক যেন আর জমিহারা না হয়, তার নিশ্চয়তা বিধানকল্পে গ্রামাঞ্চলের নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ করা, ভূমি ব্যাংক স্থাপন করা, ডিস্ট্রেস সেল নিষিদ্ধ করাসহ যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। খাস জমি, হাওর, বিল, জলমহাল ইত্যাদি উৎপাদনশীল ব্যবহারে আনার জন্য এসবের মালিকানা দরিদ্র-দুঃস্থ-ভূমিহীন উৎপাদকদের সমবায়ের হাতে ন্যস্ত করা। বাজার ব্যবস্থার কারসাজিতে গ্রাম থেকে ঢালাওভাবে উদ্বৃত্ত উঠিয়ে আনার নীতি পরিবর্তন করা এবং কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে তার সিংহ ভাগ বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা। সার, বীজ, ওষুধ, পাম্প ইত্যাদি কৃষি উপকরণসমূহ সস্তায় যথাসময়ে খোদ উৎপাদকের কাছে সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। আধুনিক কৃষি উপকরণাদি নিজেদের দেশে নিজেরাই তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া। ‘বিএডিসি’কে শক্তিশালী ও দক্ষ করে তোলা। কৃষি উপকরণাদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অধিকাংশ কৃষকের অক্ষমতা ও এক্ষেত্রে নানাবিধ জটিলতা দূর করার জন্য কৃষি উপকরণ ব্যবহার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সহায়তা, স্থানীয় ভিত্তিক সমবায় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি প্রবর্তন করা। ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ন্যায্য দামে ফসল ক্রয়, বাফার স্টক গড়ে তোলা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য দূর করার জন্য বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনায় যৌথ উদ্যোগ প্রবর্তন করা। কৃষকের উৎপাদন সমস্যার সমাধান করা। কৃষিপণ্য ও কৃষি উপকরণের মূল্য এবং অকৃষিজাত পণ্যের মূল্যে অসামঞ্জস্যতা দূর করা। প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি ঋণের ব্যবস্থা সম্প্রসারিত করা। শস্যবীমা ও ভূমি ব্যাংক চালু করা। সরল সুদে যথাসময়ে ও দুর্নীতি-হয়রানিমুক্তভাবে খোদ কৃষকের জন্য ঋণপ্রাপ্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। তাছাড়া ঋণ সমবায় ব্যবস্থার বিপুল প্রসার ঘটানো। খাদ্যশস্য উৎপাদনের পাশাপাশি অন্যান্য ফসল উৎপাদন, মৎস্য চাষ, পশুপালন ইত্যাদি সুষমভাবে বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্মকান্ড প্রসারিত করা। গ্রামাঞ্চলে কৃষিবহির্ভূত নানা খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা। কৃষিভিত্তিক শিল্প, কুটির শিল্প, সেবামূলক কার্যক্রমসহ বহুমুখী উদ্যোগ প্রসারিত করা। এক্ষেত্রে স্বনিয়োজিত ও সমবায়ী ব্যবস্থায় কর্মসংস্থান গড়ে তোলার এক বিপুল উদ্যোগ গ্রহণ করা। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে নিয়োজিত সকল কর্মকান্ড একটি সাধারণ বৃহৎ পরিকল্পনায় সমন্বিত করা। কর্মরত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) উপর জনগণের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা। (গ) বহুমুখী ও বহুমাত্রিক ধারায় শিল্পের যথাসম্ভব দ্রুত বিকাশের ব্যবস্থা করা এবং এজন্য দেশীয় শক্তি-সম্পদ-সম্ভাবনার সর্বোচ্চ সমাবেশ ও দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা ও বৈদেশিক ঋণ-সাহায্যের সুবিবেচনা প্রসূত ব্যবহার নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী, মিশ্র ও ব্যক্তিগত মালিকানায় শিল্প উদ্যোগ প্রসারিত করা এবং দক্ষতা, লাভজনকতা, অর্থনৈতিক বিকাশের সামগ্রিক প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক কল্যাণ ও প্রবৃদ্ধির নিশ্চয়তার বিষয়সমূহ এক সাথে বিবেচনায় রেখে এর প্রত্যেকটি খাতের যথাযথ ও সুপরিকল্পিত ভূমিকা নিশ্চিত করা। শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, সামগ্রিক জাতীয় ও সামাজিক স্বার্থ ও স্বাধীন-স্বনির্ভর অর্থনীতি বিকাশের স্বার্থে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে দক্ষ ও লাভজনক করে তা সংহত, প্রসারিত ও নিয়ামক খাতে পরিণত করা। রাষ্ট্রীয় খাতের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এই খাতে ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি পুনর্গঠন, দক্ষ দেশপ্রেমিক ব্যবস্থাপক বাহিনী গড়ে তোলা, উপযুক্ত বিকেন্দ্রীকরণ, পারফরমেন্স কনট্রাক্ট ব্যবস্থার প্রবর্তন, মাথাভারি প্রশাসনের সঙ্কোচন, শ্রমিক-কর্মচারীদের দক্ষতা-কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি, কারখানার বাড়তি শ্রমিকদের নিয়ে নতুন কারখানা স্থাপন, সামগ্রিক জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে সহায়ক নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করা। রাষ্ট্রায়ত্ত খাত ও সরকারি মালিকানায় শিল্প সেবা কার্যক্রম প্রসারিত করা। ছোট, মাঝারি, কৃষিভিত্তিক শিল্প, অপ্রচলিত শিল্প ও কুটির শিল্পকে বিশেষ সহায়তা প্রদান করা। প্রকৃত শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা এবং উৎপাদনশীল অবদানের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা দূর করা। ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের কাকে কাকে কী কী সুবিধা দেয়া হচ্ছে ও তাদের সাফল্য-ব্যর্থতার বিবরণ নিয়মিতভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ করা। শিল্পখাতে একচেটিয়া প্রবণতা প্রতিরোধ ও বৈষম্যহীন প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা। উৎপাদনশীল খাতে প্রদত্ত সরকারের ঋণ আত্মসাৎকারীদের কাছ থেকে খেলাপি ঋণের টাকা আদায়, তাদের বিচার ও কালো তালিকাভুক্ত করা। (ঘ) উৎপাদনশীল খাতের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ প্রসার নিশ্চিতকল্পে সামরিক খাত ও মাথাভারি প্রশাসনসহ সকল অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বরাদ্দ যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে হ্রাস করা। জাতীয়ভাবে উৎপাদিত হচ্ছে বা উৎপাদন করা সম্ভব এরূপ পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা, বিলাসদ্রব্য আমদানি সঙ্কোচন করা। অর্থনীতিতে ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের আধিপত্য দূর করা। এভাবে প্রথম অবস্থায় আমদানি অর্ধেকে নামিয়ে আনা। ভোগবাদী প্রবণতা রোধ ও মিতব্যয়িতার ধারায় আন্দোলন প্রসারিত করে ক্ষেত্র বিশেষে এজন্য আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের বিপুল প্রসার ঘটানো। ব্যাপক জনগণের কার্যকর ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করা। দেশের বিপুল জনশক্তিকে অর্থনৈতিক বিকাশের কার্যকর উপাদান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মানব সম্পদ বিকাশের লক্ষ্যে বহুমুখী কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করা। কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে অর্থনৈতিক নীতি ও কার্যব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কর্তব্য রূপে গণ্য করে অগ্রসর হওয়া। (ঙ) জাতীয় স্বার্থে নিজস্ব চাহিদা ও প্রয়োজনের স্বার্থে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিদেশী সাহায্য পাওয়া গেলে তা গ্রহণ করা। যখন যে বিদেশী সাহায্য গ্রহণ করা হবে তা কোন প্রকল্পের জন্য ও কী কী শর্তে নেয়া হচ্ছে, কারা এই বিদেশী সাহায্যের টাকা ব্যবহার করছেন বা বিনিয়োগ কাজে লাগাচ্ছেন সেসব বিষয়ে সকল তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা। উন্নত প্রযুক্তিগত শিল্পের ক্ষেত্রে বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় রেখে বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ নীতি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। বহুজাতিক কর্পোরেশনের তৎপরতা সুস্পষ্ট নিয়ম-নীতির ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রিত করা। তৃতীয় বিশ্বের জন্য উন্নত প্রযুক্তি প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা। (চ) চোরাচালানি, মজুদদারি, কালোবাজারি, ঘুষ, দুর্নীতি, অপচয়, আমলাতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা, অব্যবস্থা, নৈরাজ্য প্রভৃতি কঠোরভাবে দমন করা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও কার্যকর নীতি-ব্যবস্থা, আইন-কানুনের ভিত্তিতে সচল করা। অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা ও গতিময়তা নিশ্চিত করা। (ছ) আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে দেশের মেধা শক্তির পরিপূর্ণ ব্যবহারে উদ্যোগী হওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অনুপ্রবেশের পরিকল্পিত কার্যক্রম অগ্রসর করা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত গবেষণার ক্ষেত্রে দেশীয় গবেষকদের সর্বপ্রকার আনুকূল্য প্রদান করা। গবেষকদের মাঠের চাহিদার সাথে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করা। রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও প্রসারিত করা। প্রবাসী বাঙালিদের আয়-উপার্জন জাতীয় অর্থনীতিতে বিনিয়োজিত করার প্রক্রিয়া উৎসাহিত করা। (জ) জাতীয় অর্থনীতি বিকাশের দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সেই ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া। সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক ও স্থানীয়ভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, নিচ থেকে উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারা এগিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। পরিকল্পিত উন্নয়ন ও সেবামূলক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা প্রণয়ন, সম্পদ সংগ্রহ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের বিশেষত সংশ্লিষ্ট উৎপাদক কর্মীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। (ঝ) বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বৈষম্যমূলক শর্তসম্পন্ন সকল অসম আন্তর্জাতিক আর্থিক ও বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করা এবং তৃতীয় বিশ্বের অনুকূলে নতুন বিশ্ব আর্থিক ও বাণিজ্য ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম জোরদার করা। বিশ্ব অর্থনীতির উপর সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব ও তার নয়া উপনিবেশিক শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর অনুকূলে নয়া বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম জোরদার করা। সেই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সংহতি জোরদার করা। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক সম্পর্ক তথা দক্ষিণ-এশীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা প্রসারিত করা। স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতি বিকাশের স্বার্থে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সুদৃঢ় আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার ধারা প্রতিষ্ঠা করা। ৩. দারিদ্র্য বিমোচন অন্য যে কোনো কাজের চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে নিরন্ন, দারিদ্র্যপীড়িত জনগণের ন্যূনতম বেঁচে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করা। বেকার ও অর্ধ বেকার কর্মক্ষম সকলের জন্য ১০ বছরের মধ্যে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রাথমিকভাবে দেশের সবচেয়ে দরিদ্র এক-তৃতীয়াংশ উপজেলায় খরা মৌসুমে টাস্কফোর্সের পরামর্শ অনুযায়ী কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা স্কিম চালু করা এবং পর্যায়ক্রমে তা সকলের জন্য সম্প্রসারণ করা। গ্রাম ও শহরের বেকার মানুষের স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা প্রসারিত করার জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত এবং পরিকল্পিত বরাদ্দ নিশ্চিত করা। গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত কৃষি-অকৃষি খাতে কর্মরত গ্রামীণ মজুরদের জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি প্রণয়ন করা এবং পূর্ণাঙ্গ কৃষি শ্রম আইন প্রণয়ন করা। আইএলও সনদের ১৪১ এবং ১৪৯ ধারা অনুস্বাক্ষর করা এবং তা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাস্তবায়নে গ্রামীণ মজুরদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিতকল্পে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। গ্রামীণ নারী মজুরদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৪. বসতভিটা, গ্রাম উন্নয়ন ও নগরায়ণ বাস্তুহীন, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র সকল পরিবারের জন্য ন্যূনতম বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। গ্রামীণ বাস্তুহীনদের জন্য উপযুক্ত খাস জমি বাস্তুভিটার জন্য বরাদ্দ করা। প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা করা। বহু ফসলী এবং প্রান্তিক ও ক্ষুদে কৃষকের জমি অধিগ্রহণ না করা। অধিগ্রহণ করা জমির ন্যায্য দাম ভূমি মালিককে দ্রুত প্রদান করা। দরিদ্রদের গৃহনির্মাণ ঋণ প্রকল্পের জন্য সরকারি বাজেট বরাদ্দ, বহুমুখী সরকারি কার্যক্রম ও বিভিন্ন বেসরকারি সাহায্য কার্যক্রম সমন্বিতভাবে অগ্রসর করা। গ্রামীণ অর্থনীতি ও গ্রামীণ জীবনের বিপ্লবী পুনর্গঠন ও উন্নতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে ব্যাপক মানুষের শহরাভিমুখী আগমন রোধ করা। দ্রুত ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে ওঠা শহরগুলোতে পৌর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা এবং বস্তিবাসীদের পূনর্বাসনের ব্যবস্থা সাপেক্ষে তাদের জন্য পৌরজীবনের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা। ৫. স্বাস্থ্য পরিষেবা ও চিকিৎসা সকল নাগরিকের জন্য সুষম ও অভিন্ন চিকিৎসা নীতি, স্বাস্থ্য নীতি ও ওষুধ নীতি চালু করা। এই খাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা। বাণিজ্যিকীকরণ রোধ করা। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যাভিত্তিক স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তোলা। বিশুদ্ধ পানীয় জলের সরবরাহ, স্যানিটেশন, রোগ প্রতিষেধক ব্যবস্থার সম্প্রসারণ করা, ইউনিয়ন পর্যায়ে মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্রসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করা, থানাসমূহে উন্নত চিকিৎসা সুযোগ সম্পন্ন হাসপাতাল স্থাপন করা। বিভিন্ন দেশজ চিকিৎসা পদ্ধতির আধুনিকায়নের জন্য গবেষণা কাজে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা। শারীরিক, শ্রবণ, বাক, দৃষ্টি ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট জাতিসংঘ সনদ বাস্তবায়নসহ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। লিঙ্গ-প্রতিবন্ধীদের (হিজরাদের) অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা। ৬. শিক্ষা ও সংস্কৃতি (ক) সার্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, বৈষম্যহীন, গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা। শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য রোধ করা। অভিন্ন সাধারণ শিক্ষা এবং তার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষা, প্রায়োগিক শিক্ষা ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সার্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করা। নিরক্ষরতা দূর করার জন্য ব্যাপক গণশিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করা। প্রতি দুই বর্গকিলোমিটারে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। প্রাথমিক শিক্ষা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও গণশিক্ষা কার্যক্রমকে প্রাধান্য দিয়ে একই সাথে উচ্চশিক্ষার যথাযথ প্রসার ও উন্নতি বিধান করা। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে দরিদ্র-মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর জন্য বৃত্তি ও শিক্ষাঋণ প্রকল্প চালু করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ রোধ করা। (খ) ইউনেস্কো’র সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষাখাতে বাজেটের বরাদ্দ বাড়িয়ে ৩৩ ভাগ করার লক্ষ্যে ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া। বাঙালি জাতির সুষ্ঠু, মানবিক, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ধারা অগ্রসর করা এবং জীবনবিমুখ, ভোগবাদী, অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ অপসংস্কৃতির প্রসার রোধ করা। (গ) সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল, কুসংস্কারমূলক ধ্যান-ধারণা দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। বিজ্ঞানমনষ্কতা, বিজ্ঞান চর্চা, মুক্তবুদ্ধি চর্চার বিকাশ ঘটানো। জনগণের সকল সৃজনশীল উদ্যোগকে উৎসাহিত করা, পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা ও উপযুক্তভাবে কাজে লাগানো। (ঘ) সামাজিক-সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতা দূর করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা। জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম, গণতান্ত্রিক চেতনা, অন্যায়-অবিচার-শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেরণা, বিপ্লবী মানবতাবোধ ও প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণা জাগরিত ও প্রসারিত করার জন্য ধারাবাহিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা। ৭. দ্রব্যমূল্য দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সীমিত রাখার ব্যবস্থা করা। এ জন্য গ্রাম ও শহরের গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য স্থায়ী রেশনিং ব্যবস্থা, ন্যায্যমূল্যের দোকান, ক্রেতা সমবায়, সরকারি উদ্যোগে বাফার স্টক গড়ে তোলা ইত্যাদি ব্যবস্থা করা। দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত শক্তিশালী গণবণ্টন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা। মজুদদারি, কালোবাজারি ও চোরাচালানি কঠোর হাতে দমন করা। ৮. ঘুষ-দুর্নীতি-অপরাধ-সন্ত্রাস ঘুষ-দুর্নীতি রোধকল্পে কঠোর নিবারণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং সকল নীতিহীন তৎপরতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। রাষ্ট্রের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের ও দেশের সকল রাজনৈতিক দলের এবং নেতাদের সম্পদ, আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়মিত প্রকাশের ব্যবস্থা করা। দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের নিয়ে ন্যায়পাল কমিটি গঠন করে তাদের হাতে এই বিষয়টি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ন্যস্ত করা। চুরি-ডাকাতি-হাইজ্যাক-খুন-রাহাজানি প্রভৃতি রোধকল্পে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও সমাজবিরোধী দুষ্কৃতিকারীদের দৌরাত্ম ও নানাবিধ অপরাধমূলক কাজকর্ম কঠোরভাবে দমনের ব্যবস্থা করা। সংগঠিত অপরাধ চক্রসমূহের মূল সম্পূর্ণভাবে উৎপাটিত করা। বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করা এবং সন্ত্রাসী অপশক্তিকে শিক্ষাঙ্গনসহ সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্র থেকে কঠোরতম ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্মূল করে সন্ত্রাসমুক্ত সামাজিক জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করা। ৯. নারী সমাজ নারী সমাজের উপর পরিচালিত নানা অন্যায়, অত্যাচার ও বৈষম্য দূর করে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিম-লসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাদের সমান অংশগ্রহণ, তাদের সমমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কোনো প্রকার সংরক্ষণ ছাড়াই জাতিসংঘের নারীর প্রতি সকল বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডো এবং নারী উন্নয়নের বৈশ্বিক রূপরেখা স্বরূপ বেইজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন পূর্ণ বাস্তবায়ন করা। ধর্ষণ, ফতোয়াবাজি, যৌতুক প্রথাসহ সকল প্রকার নারী নির্যাতন কার্যকরভাবে রোধ করা। বর্তমানে প্রচলিত আইনে ও উত্তরাধিকার আইনের ক্ষেত্রে নারীর প্রতি যে বৈষম্য বিরাজ করছে, তা দূর করা এবং ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড চালু করা। প্রাথমিক পর্যায়ে নারী সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য ইতিবাচক পক্ষপাতমূলক বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করা। নারী ও পুরুষের মধ্যে কাজ ও মজুরির ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা করা। কর্মস্থলে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করা। নারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। গণমাধ্যমে নারীর গৎবাঁধা, চিরাচরিত ও অমর্যাদাকর ইমেজ পরিবর্তন করা। জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা। ১০. সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর অত্যাচার, বৈষম্য নির্মূল করে তাদের জন্য পরিপূর্ণ নিরাপত্তা, সমমর্যাদা নিশ্চিত করা। অর্পিত সম্পত্তি আইন দ্বারা আটকে রাখা সম্পদ দ্রুত তার প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া। সমাজের সর্বক্ষেত্র থেকে সকল ধরনের সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করা। জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহের অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা। তাদের নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতির বিকাশ নিশ্চিত করা। পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত নিপীড়ন বন্ধ করা। আদিবাসীদের অধিকার সম্মানজনকভাবে রক্ষার্থে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করা এবং তাদের উন্নয়নের জন্য তাদের নিজস্ব গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনগত, প্রশাসনিক ও অন্যান্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ১১. শিশু-কিশোর শিশু-কিশোরসহ দেশের নতুন প্রজন্মের স্বার্থরক্ষা ও তাদের বহুমুখী প্রতিভা বিকাশের সুযোগ ও সৃজনশীল আকাঙ্ক্ষাসমূহ পূরণের ব্যবস্থা করা। শিশুদের সৃজনশীল বিনোদনের জন্য উপযুক্ত সামাজিক পরিবেশ ও কাঠামো গড়ে তোলা। সরকার ও ব্যক্তি মালিকাধীন আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সকল এলাকায় যেন শিশুদের খেলার মাঠ থাকে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া। শিশুশ্রম বন্ধ করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ১২. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জনশক্তি উন্নয়ন প্রচলিত জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাদি প্রসারিত করার পাশাপাশি জনগণের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পুষ্টির উন্নতি, সচেতনতা-সংস্কৃতির উন্নয়ন, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসসহ প্রতিটি মানুষকে মর্যাদাসম্পন্ন করে তোলার কার্যক্রমের মাধ্যমে ছোট পরিবার গঠনের বিষয়টিকে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষায় পরিণত করা। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করা। জনশক্তিকে সম্পদ হিসেবে গণ্য করার মানসিকতা দৃঢ়মূল করা। এসব প্রয়াসের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১০ বছরের মধ্যে শূন্যের কোঠায় কমিয়ে আনা। ১৩. পানি উন্নয়ন ও বন্যা সমস্যা যথাযথ পানি ব্যবস্থাপনা ও বন্যা সমস্যা সমাধানের জন্য জাতীয় ভৌগোলিক ও পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য ও উপযোগিতা বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা এবং এজন্য জাতীয় ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হওয়া। একটি সামগ্রিক পানি নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা এবং তার আওতায় সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ করা। দেশের নদ-নদী ও জলাশয়সমূহ দখল ও দুষণমুক্ত করা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি রোধ করা। ১৪. প্রাকৃতিক সম্পদ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদসহ দেশের সমুদয় প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধান, উত্তোলন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়া। প্রাকৃতিক সম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করা। এক্ষেত্রে বহুজাতিক কোম্পানির সাথে স্বাক্ষরিত জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ণকারী সকল চুক্তি দেশীয় স্বার্থের অনুকূলে সংশোধন করা। দেশের পানি সম্পদ, ভূমি সম্পদসহ সকল প্রকার প্রাকৃতিক সম্পদকে টেকসই মানব উন্নয়নের কাজে লাগানোর লক্ষ্যে সে সবের যথাযথ সমন্বয় ও দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কার্যকর করা। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে জাতীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও জাতীয় স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদী মহাপরিকল্পনা কার্যকর করা। নৌপথ ও রেলপথের যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও বিকাশের অগ্রাধিকার দেয়া। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গ্রামাঞ্চলে প্রসারিত করা। ক্রমবর্ধমান যানজট দূরীকরণে সড়ক-মহাসড়কের প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। জনপথ ও গণপরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করা। ১৫. সুষম বিকাশ দেশের সকল অঞ্চলের সুষম বিকাশের জন্য অনুন্নত এলাকা বা অঞ্চলের উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেয়া। গ্রামাঞ্চলে ক্রমান্বয়ে আধুনিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারিত করা। বৈষম্য ও অবিচারের শিকার সমাজের বিভিন্ন অধঃস্তন অংশের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা এবং তাদের উপর পরিচালিত অন্যায়-অত্যাচার-জুলুম বন্ধ করার ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও বিশেষ সুযোগ প্রদানের ব্যবস্থা করা। ১৬. প্রকৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ু প্রকৃতি ও পরিবেশ বিধ্বংসী সকল প্রক্রিয়া রোধকল্পে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। উন্নয়ন ধারায় ও প্রযুক্তি ব্যবহারে পরিবেশ বান্ধব বিকল্প অনুসরণ করা। সমুদ্র ও নদী দূষণ, আর্সেনিক, বায়ু ও শব্দ দূষণসহ সব ধরনের দূষণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বনাঞ্চল ধ্বংস, বৃক্ষ নিধন, জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস, পাহাড় কাটা, জলাধার ভরাট করাসহ পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্টকারী কার্যক্রম বন্ধ করে প্রকৃতির সাথে ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন ধারা নিশ্চিত করা। বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার বহু গুন বৃদ্ধি করা। সব নাগরিকের জন্য সুপেয় জলের নিশ্চয়তা বিধান করা। পুঁজিবাদী মুনাফাসর্বস্ব পরিবেশ বিধ্বংসী উন্নয়ন ধারার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন জোরদার করা। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দায়ী দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় এবং বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সর্বাঙ্গীন উন্নতি ও দক্ষতা নিশ্চিত করা। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার প্রবণতা ও পরিবেশ দূষণ প্রক্রিয়া রোধকল্পে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ১৭. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিদেশ নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস করা এবং সাম্রাজ্যবাদ, দাতা দেশ ও বহুজাতিক অর্থশক্তির সাথে আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে, ধারাবাহিকভাবে সুদৃঢ় নীতি অনুসরণ করা। স্বাধীন ও সক্রিয় জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করা। পারস্পরিক স্বার্থ, সমমর্যাদা ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতির ভিত্তিতে বিশ্বের সকল দেশের সাথে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সুসম্পর্ক বজায় রাখা। তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের সাথে সম্পর্ক সম্প্রসারণ ও গভীরতর করার জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগী হওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব-নির্ভর বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রবণতা রোধ, আন্তর্জাতিক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের গণতন্ত্রায়ন, জাতিসংঘ ও তার বিভিন্ন সংস্থার গণতন্ত্রায়ন এবং প্রতিটি জাতির নিজস্ব পথ বাছাইয়ের অধিকারের জন্য দৃঢ় সংগ্রাম পরিচালনা করা। স্থায়ী বিশ্বশান্তি ও পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করা। সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, আধিপত্যবাদ, বর্ণবাদ, জায়নবাদ, নব্য নাৎসিবাদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা এবং এসবের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত জাতি ও আন্দোলনসমূহের প্রতি সংহতি জোরদার করা। ভারত, পাকিস্তান প্রভৃতি দক্ষিণ এশীয় দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি এসব দেশের সাথে ঝুলে থাকা সমস্যাগুলোর যথা, ভারতের সাথে সকল নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত চিহ্নিতকরণসহ বিরাজমান সমস্যা, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের প্রাপ্য সম্পদ আদায় করা ও আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত পাঠানো ইত্যাদি সমস্যা জাতীয় স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রেখে সমাধান করা। উপমহাদেশকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করা এবং এ অঞ্চলের আত্মঘাতী অস্ত্র প্রতিযোগিতা রোধ করা। ‘সার্ক’ সংস্থার কার্যক্রমকে বহুমুখী ধারায় প্রসারিত করা এবং তার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে সুসম্পর্ক ও সহযোগিতার ভিত্তি প্রসারিত ও গভীরতর করা। ‘সার্ক’ কাঠামোর মধ্যে গড়ে ওঠা আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রক্রিয়ায় জাতীয় স্বার্থ ও অবস্থানকে সমুন্নত রাখা ও অগ্রসর করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকা। ‘সার্ক’ দেশসমূহের শ্রমজীবী জনগণ ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের মধ্যে সংহতি ও সহযোগিতা গভীরতর করা।