Revolutionary democratic transformation towards socialism

‘সামাজিক বিপ্লবীই মানুষের মুক্তি দিতে পারে’ ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যে কোনো আস্ফালন সহ্য করা হবে না’


বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সাধারণ সম্পাদক, বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, সামাজিক বিপ্লব সংগঠিত করার স্বপ্ন নিয়ে কমরেড মণি সিংহ তার জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। এই সামাজিক বিপ্লবই মানুষের মুক্তি দিতে পারে। সিপিবি এই সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে তার সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। একমাত্র সমাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়েই সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করে দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও শোষণ বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়া যাবে।

সিপিবির সাবেক সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা, এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, দেশের মানুষের শোষণমুক্তি, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ কমরেড মণি সিংহ এর ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আজ ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, সকাল ৮টায়  ঢাকার পোস্তাগোলা শ্মশানঘাটে তাঁর স্মৃতিস্তম্ভে পুস্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পর অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় তিনি এসব কথা বলেন।

শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পর সূত্রাপুর থানা কমিটির সভাপতি কমরেড বিকাশ সাহার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড গোলাম রাব্বী খানের সঞ্চালনায় স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন- সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক জননেতা কমরেড রুহিন হোসেন প্রিন্স, সহকারী সাধারণ সম্পাদক কমরেড মিহির ঘোষ, বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসেন খান, ডিএসকে’র পরিচালক ও সাবেক ছাত্রনেতা শামসুল আলম, সিপিবি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নেতা সাইফুল ইসলাম সমীর, সূত্রাপুর থানা কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটি, সূত্রাপুর থানা কমিটিসহ বিভিন্ন শাখা, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কমরেড মণি সিংহ-কমরেড ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট, দুঃস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংগঠন পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে কমরেড মনি সিংহের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ২০০ বছরের ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম, ২৪ বছরের পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পটভূমিতে ১৯৭১ সালে অস্ত্র হাতে এ দেশের আপামর মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের রক্ত দানের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। এই সংগ্রাম গড়ে তোলা, মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়ে কমিউনিস্ট পার্টি ও কমরেড মণি সিংহের ভূমিকা ছিল অন্যতম। 

তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছিল ১৯৭২ এর সংবিধান। ওই সংবিধানের মূল ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। যা এই দীর্ঘ সংগ্রামের পটভূমিতে রচিত হয়েছিল। দেশবাসী এটাকে গ্রহণ করেছিল। যা এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। ওই সংবিধানে অসম্পূর্ণতাও ছিল, এখনো আছে। ১৯৭২ সালেই সিপিবি তৎকালীন সরকারের কাছে ওই অসম্পূর্ণটা তুলে ধরে সংশোধনের কথা বলেছিল। এরপর বিভিন্ন সময় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নানা কানুন, অগণতান্ত্রিকতা এই সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে । এছাড়া সময়ের বিবেচনায় মানুষ এবং দেশের প্রয়োজনে এই সংবিধানকেও উন্নত করা দরকার। কিন্তু আমরা ক্ষোভের সাথে লক্ষ্য করছি কেউ কেউ এই সংবিধানকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া, এমনকি ‘কবর’ রচনা করার কথাও বলছে। বাংলাদেশকে মানে, দেশের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধকে মানে, এমন কেউ বা কোনো শক্তি একথা বলতে পারে না। স্বাধীনতাবিরোধী বা দেশবিরোধীরাই এসব কথা বলতে পারে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যে কোনো আস্ফালন সহ্য করা হবে না। 

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর ক্ষমতায় থাকা শাসকগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা গণতন্ত্র, বৈষম্যমুক্ত, শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক দেশ করতে পারেনি। এরপর বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে বিশেষ করে ১৯৯০’র গণ-অভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ এ বছরের জুলাই-আগস্টের হাজারো মানুষের জীবনের বিনিময়ে অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র স্বৈরাচারী ব্যবস্থার উচ্ছেদ ও বৈষম্য মুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেশবাসীর সামনে এসেছে ।

তিনি বলেন, গত এক দশক ধরে সিপিবিসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংগঠন ব্যক্তি দুঃশাসনের অবসানের লক্ষ্যে সংগ্রাম করে চলেছিল। আমরা এই সময় আওয়াজ তুলে ছিলাম, ‘দুঃশাসন হটাও, ব্যবস্থা বদলাও, নীতিনিষ্ঠ বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি সমাবেশ গড়ে তোল’। এসব সংগ্রামে আমাদের দলের নেতাকর্মীরাও জীবন দিয়েছে, জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছে।

আজ এই বিজয়কে ছিনিয়ে নিতে নানা ধরনের অপশক্তি প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রাজনীতিতে নতুন নতুন বর্ণচোরাদের দেখা মিলছে। এরা চটকদার কথার মধ্য দিয়ে, আরেক ধরনের ভয়ের রাজত্ব তৈরি করে ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করছে। মুক্তিযুদ্ধ

ইতিহাস ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ওপর আঘাত আনতে দ্বিধা করছে না।

তিনি এসব অপশক্তিসহ পতিত স্বৈরাচার, আধিপত্যবাদী-সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তিকে রুখে দাঁড়াতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
 
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ২০২৪’র আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সিপিবি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে।  তিনি দেশের বিবেকবান সচেতন মানুষকে এই সংগ্রামে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান।

তিনি আগামী ৩ জানুয়ারি ২০২৫, শুক্রবার, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে যোগ দিতে শ্রমজীবী মানুষসহ দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।

অন্য বক্তারা বলেন, কমরেড মণি সিংহ রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন। কলকাতার মেটিয়া বুরুজে চটকল শ্রমিকদের প্রিয় নেতা ছিলেন তিনি। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন। টংক আন্দোলন ও তেভাগা আন্দোলনের তিনি ছিলেন রূপকার। তাঁর নেতৃত্বে টংক আন্দোলন এত ব্যাপকতা লাভ করে যে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার আন্দোলনের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয় এবং টংক প্রথা বিলুপ্ত হয়। ময়মনসিংহ অঞ্চলে যে বিশাল তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত হয়- তারও মধ্যমণি ছিলেন তিনি।

মণি সিংহ জন্মেছিলেন কলকাতা শহরে ১৯০০ সালে। তাঁর বাবা কালি কুমার সিংহ ছিলেন নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলার জমিদার পুত্র আর মা সুসং দুর্গাপুর রাজ পরিবারের মেয়ে। রাজ পরিবারে জন্মেও মণি সিংহ সমাজের বিপ্লবী পরিবর্তনের লক্ষ্যে উৎসর্গ করেন নিজেকে। বিদ্রোহ করেন নিজ পরিবারের শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে। প্রজাসাধারণকে সংগঠিত করে গড়ে তোলেন কৃষক আন্দোলন। কমরেড মণি সিংহ কলকাতায় স্কুল ছাত্রাবস্থায়ই বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন। জড়িয়ে পড়েন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামে। গোপন অনুশীলন দলে যোগ দিয়ে ব্রিটিশ বিতাড়নের সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হন। ১৯২১ সালে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। আত্মগোপন অবস্থায় দীক্ষা নেন সাম্যবাদী আদর্শের। ১৯২৫ সালে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনাপর্বেই যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে।

তিনি সব সময় বলতেন, সমবেত উন্নত জীবন না হলে উন্নত সমাজ হয় না। দেশপ্রেমের অর্থ হলো দেশের সব মানুষের খাবার-কাপড়-ঘর, চিকিৎসা-শিক্ষা এবং মন খুলে কথা বলার অধিকার নিশ্চিত করা।

পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন কমরেড মণি সিংহ। পাকিস্তানি শাসনের প্রায় পুরো সময়েই কমিউনিস্ট পার্টি ছিল নিষিদ্ধ। কমিউনিস্ট নেতারা হয় কারাগারে, নয় আত্মগোপনে থাকতেন। ৪৮’র ভুখা-মিছিল, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, টংক, নানকার, তেভাগাসহ বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি এবং মণি সিংহের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল। ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মণি সিংহের নেতৃত্বে বাম কমিউনিস্টদের ভূমিকা ছিল কার্যকর ও সার্থক। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ষাটের দশকজুড়ে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালিত হতো সেখানে মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্টরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। আত্মগোপন অবস্থায় মণি সিংহ ছাত্র-আন্দোলনের নানা বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে আন্দোলনকে সজীব রেখেছেন। ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি ষাটের দশকে নানা সংগ্রামের পটভূমিতে, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৬৭ সালে আত্মগোপন অবস্থায় কমরেড মণি সিংহ গ্রেপ্তার হন। ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থানের ফলে পাকিস্তানি সরকার অন্য রাজবন্দীদের সঙ্গে তাঁকেও মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ওই বছরই মার্চ মাসে ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন জারি হলে আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে রাজশাহীর ছাত্রজনতা রাজশাহীর কারাগার ভেঙে তাঁকে মুক্ত করে। এরপর তিনি মুক্তিযুদ্ধে আত্মনিয়োগ করেন। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে মণি সিংহ ও তাঁর সহকর্মীরা বিশেষ ভূমিকা রাখেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা পালনে মণি সিংহ ও তাঁর পার্টি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য।

কমরেড মণি সিংহ রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামে যেমন জীবন্ত এবং অগ্রণী ছিলেন—ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর সততা ও নিষ্ঠা ছিল অনুকরণীয়। মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল প্রবাদতুল্য। তিনি কখনো সহকর্মীদের বাদ দিয়ে কোনো খাবারও গ্রহণ করতেন না। তাঁর জীবন যাপন ছিল অত্যন্ত আড়ম্বরহীন। পিতৃ-মাতৃ উভয়কুল বড় জমিদার হওয়া সত্ত্বেও এবং দীর্ঘদিন দেশের অন্যতম শীর্ষ নেতৃত্ব থাকার পরও তাঁর কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। তাঁর আত্মত্যাগ, সাহস আর জীবনসংগ্রাম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিত্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। আজ তার জীবন সংগ্রাম চর্চা করা জরুরি।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন

Login to comment..