Revolutionary democratic transformation towards socialism

করোনার মরণঘাতি মহাবিপর্যয় মোকাবেলার অগ্রাধিকারমূলক কর্তব্যকে সম্পুর্ণ উপেক্ষা করে সরকারের গতানুগতিক 'গরীব মারার' বাজেট প্রস্তাবনা প্রত্যখ্যান

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড মোহম্মদ শাহ আলম আজ জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বাজেট প্রস্তাবকে ৯৯% মানুষের স্বার্থবিরোধী, গতানুগতিক, আমলাতান্ত্রিক আখ্যায়িত করেছেন। করোনা মহাবিপর্যয়কালে পীড়িত মানুষকে বাঁচানোর জন্য স্বাস্থ্য খাতের প্রাধান্য পাওয়া উচিত হলেও প্রকৃত অর্থে তা করা হয়নি। করোনা বিপর্যয় মোকাবেলার পাশাপাশি করোনার কারণে সৃষ্ট জনজীবনের সংকট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্য নির্ধারণে এই বাজেটে ব্যর্থ হয়েছে। এই বাজেটে ৯৯% সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা-রুটি-রুজি-সহায়-সম্পদ লুটপাট করে মুষ্ঠিমেয় ১% লুটেরা ধনীকদের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাজেটকে সাম্রাজ্যবাদ ও লুটেরা ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার গণবিরোধী দলিল আখ্যায়িত করে সিপিবির পক্ষে তা প্রত্যাখান করেন।

আজ সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশের পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে নেতৃবৃন্দ বলেন, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো সরকার সিপিবিসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল শক্তির বাজেট সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট সুপারিশ এবং দেশের আপামর মানুষের আকাঙ্খাকে পদদলিত করে আমলাতন্ত্রের সাজানো গতানুগতিক বাজেট ঘোষণা করেছে। প্রস্তাবিত রাজস্ব আয়ে পরোক্ষ কর প্রত্যক্ষ করের দ্বিগুণ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এই দুঃসহ ভারের সবটাই বহন করতে হবে গরিব-মধ্যবিত্তসহ সাধারণ নাগরিকদেরকে। অথচ বিত্তবানদের উপর ধার্য্য প্রত্যক্ষ কর রেয়াত অব্যাহত রাখা হয়েছে। অপ্রদর্শিত কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। করোনাকালে প্রদত্ত প্রণোদনার প্রায় পুরোটাই ধনিকশ্রেণির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাজেট বরাদ্দের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সিংহভাগ বিত্তবানদের স্বার্থে ব্যয় করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেটে এভাবে গরিব জনগণের সম্পদ মুষ্ঠিমেয় লুটেরা ধনিকের হাতে প্রবাহিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

নেতৃবৃন্দ বলেন, এবারের বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আগে ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশে মধ্যে ধরে রাখার চেষ্টা করা হলেও এবার সেটা ৬ শতাংশের বেশি হবে, যা উদ্বেগজনক। এই বিপুল পরিমাণ বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য নতুন করে অভ্যন্তরীণ খাত ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাঁধে বিশাল ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে বাজেটের পরিমাণকে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা করা হয়েছে। প্রতিবছর যেমন অতীতের চেয়ে বাজেট ব্যয় সর্বোচ্চ হয় তেমনি ঘাটতিও হয় সর্বোচ্চ। এবারো তাই হয়েছে। বাজেটের বেশির ভাগ খরচ হবে পূর্বের ঋণ পরিশোধ, শ্বেতহস্তির মতো বিশাল সিভিল-মিলিটারি প্রশাসন পরিচালনা ব্যয়, বিলাস দ্রব্য আমদানি, অপচয়, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন প্রকারের সিস্টেম লস, কর-রেয়াতের নামে ধনিক শ্রেণিকে বিশাল ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি কাজে। এসবই হলো লুটেরা ধনিক শ্রেণির স্বার্থে গৃহীত পদক্ষেপ।

নেতৃবৃন্দ বলেন, করোনাকালে নতুন করে আড়াই কোটি লোক দারিদ্রসীমার নীচে নেমে গেছে। কাজ হারানো ও নতুন সৃষ্ট বেকারদের কর্মসংস্থানের নির্দিষ্ট কোনো রুপরেখা এ বাজেটে নেই। করোনাকালে প্রণীত এ বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার কোনো লক্ষণ এ বাজেটে নেই। এ বাজেটে এবারো কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখার মাধ্যমে অর্থনীতিতে লুটপাটের ধারা আরো জোরদার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

নেতৃবৃন্দ বলেন, জনগনকে 'ঘাতক করোনার' আতংকে কম্পমান রাখা, ধনীকে আরো ধনী এবং গরিবকে আরো গরিব করা, ধন-বৈষম্য ও শ্রেণি-বৈষম্য বৃদ্ধি করা, সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য বৃদ্ধি করা ইত্যাদি হবে এই বাজেটের ফলাফল। এই বাজেট জাতির অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা ও নাজুকতা বাড়িয়ে তুলবে। নেতৃবৃন্দ বলেন, করোনা মহাবিপর্যয়কালে বাজেটে মানুষের জীবন-জীবিকাকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কৃষি-কর্মসংস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে ৯৯% এর জন্য বাজেট প্রণয়ন করার প্রয়োজন ছিল। এজন্য বাজেটে অর্থ সংস্থানের জন্য পরোক্ষ করের পরিবর্তে প্রত্যক্ষ করের উপর জোর দেয়া প্রয়োজন ছিল। বাজেটের পরিমাণ বাড়াতে খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায়, অপ্রদর্শিত কালো টাকা ও বিদেশে পাচারকৃত টাকা দেশে ফেরত আনা ও বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় ভাবে বিনিয়োগের রোডম্যাপ দেয়া দরকার ছিল। বাজেটের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপচয়, সিস্টেম লস, বিলাসিতা ইত্যাদি রোধ করে মিতব্যয়িতা প্রদর্শন, প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস, সর্বনিম্ন-সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দিনগুলোর মতো ১:৬ করা, সব ধরনের দুর্নীতি-অনিয়ম কঠোরভাবে দমন ও নিবৃত্ত করা, অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ হ্রাস করা, প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও যুক্তি সঙ্গত মাত্রায় কমিয়ে আনা, যথা সম্ভব সরকারি ক্রয় হ্রাস করা, মেগা প্রজেক্ট গ্রহণ আপাততঃ স্থগিত রাখাসহ নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন ছিল।

নেতৃবৃন্দ বলেন, বাজেটের অর্থ সংস্থানের পথনির্দেশনার সাথে সাথে করোনাকালে রাজস্ব ব্যয় কমিয়ে বাজেটের উন্নয়ন-বিনিয়োগের অগ্রাধিকারের চিহ্নিত করা প্রয়োজন ছিল। তারা বলেন, এ জন্য বাজেটের প্রথম এক-তৃতীয়াংশ স্বাস্থ্য, শিক্ষা-গবেষণা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, পরিবেশ, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি খাত তথা সামাজিক কল্যাণ ও সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণ খাতে, বাজেটের দ্বিতীয় এক-তৃতীয়াংশ কৃষি খাত, শিল্প খাত, স্বনিয়োজিত বিনিয়োগ, আত্মকর্মসংস্থান, বেকারত্ব দূরীকরণ ইত্যাদি খাতে এবং শেষ এক-তৃতীয়াংশ দেশের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ব্যয় করা দরকার ছিল। নেতৃবৃন্দ বলেন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা-গবেষণা খাতে বাজেটের যথাক্রমে ১২ ও ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়ার প্রয়োজন ছিল। সেই সাথে শক্তিশালী গণ-বন্টন ব্যবস্থা গড়ে তুলে বিপর্যয় কালে অনাহারী মানুষের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া জরুরি ছিল। নেতৃবৃন্দ গ্রাম-শহরের গরিব মানুষদের কন্ট্রোল রেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে অবিলম্বে তা চালু করার দাবি জানান।

নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, চলতি অর্থ বছরের প্রথম সাত মাসে এডিপির মাত্র ৩৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। তারা এডিপি বাস্তবায়নের মাত্রা ও মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন শুধু এডিপি গ্রহণ করলেই হবে না তার মানসম্মত বাস্তবায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। নেতৃবৃন্দ বাজেটে বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভূত আয়ের উপর ধার্য্যকৃত ১৫ শতাংশ কর যাতে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা না হয় সে বিষয়ে তীক্ষ্ম নজর রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষি-কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃদ্ধির দাবি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং উল্টো কোনো কোনো ক্ষেত্রে আনুপাতিক বরাদ্দ কমানো হয়েছে। সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য কিছু প্রতীকী পদক্ষেপের ছিটেফোঁটা যুক্ত করা হয়েছে। বাজেট ও সম্পূরক বাজেটের মধ্যে বিপুল পার্থক্য একথার সত্যতাই প্রতিষ্ঠা করেছে যে বাজেট প্রস্তাব নিছক একটি কথার কথা মাত্র। বাজেটকে অনির্ভরযোগ্য ও অবাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাবে পরিণত করা হয়েছে। বাজেটের তথ্য-ভিত্তির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। তাই, প্রস্তাবিত জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে সরকারের আন্তরিকতা ও সেসব বাস্তবায়নে তার সক্ষমতা-যোগ্যতাও মানুষের মনে প্রশ্নবিদ্ধ।

নেতৃবৃন্দ বলেন, উত্থাপিত বাজেট ‘জীবন-জীবিক ‘ রক্ষার স্লোগান দেয়া হলেও তা বাস্তবে উপেক্ষিত হয়েছে। এ বাজেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষকে রক্ষার কোনো বাস্তব দিকনির্দেশনা নেই। এ বাজেট প্রকৃত অর্থেই ‘গরিব মারার বাজেট।’ নেতৃবৃন্দ বাজেট প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তা প্রত্যাহার করে চলমান করোনাকালীন কঠোর বাস্তবতার আলোকে স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কৃষি-কর্মসংস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থে সমাজতন্ত্র অভিমুখিন বাজেট প্রণয়নের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান।


Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন

Login to comment..